মাঈনুল ইসলাম নাসিম : মেধা-যোগ্যতা সাহস-সামর্থ আন্তরিকতা-উদারতা সর্বোপরি ইষ্পাত কঠিন মনোবল আর দেশপ্রেমকে কাজে লাগিয়ে দূর প্রবাসে যাঁরা নিযেদের ধ্যান-জ্ঞান-সাধনার সবটাই মেলে ধরেছেন খেটে খাওয়া বাংলাদেশীদের কল্যানে, তাঁরা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের গর্বের ধন, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। ইউরোপের দেশে দেশে কমিউনিটির কল্যান নিশ্চিত করতে নিজেদেরকে নিঃস্বার্থভাবে উৎসর্গ করা ঠিক তেমনি দু’জন আলোকিত মানুষ গ্রীসের ইঞ্জিনিয়ার ড. জয়নুল আবেদিন এবং ফ্রান্সের কাজী এনায়েত উল্লাহ। দু’জনই প্রবাসে আছেন তিন যুগেরও বেশি সময়, সিক্ত আজ তাঁরা লাখো বাংলাদেশীর ভালোবাসায়। ইউরোপের ৩০টি দেশের বাংলাদেশীদের সম্মিলিত সংগঠন অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ এসোসিয়েশন (আয়েবা)’র গতিশীল নেতৃত্বে আছেন সফল এই দুই কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব।
চল্লিশ বছর আগে ১৯৭৫ সালে তৎকালীণ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশেষ স্কলারশিপ নিয়ে বাংলাদেশকে বিদায় জানান কুমিল্লার কৃতি সন্তান জয়নুল আবেদিন। তাসখন্দ থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে কৃতিত্বের সাথে মাস্টার্স সহ পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। আশির দশকে জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থা ইউনাইটেড নেশানস ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইউনিডো)’র কনসালটেন্ট হিসেবে ভিয়েনা ও ভিয়েতনামে কর্মরত ছিলেন মেধাবী প্রকৌশলী জয়নুল আবেদিন। ঢাকার কনকর্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড কনস্ট্রাকশনেও ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন তিনি। নব্বই’র দশকের শুরুতে মূলতঃ ব্যবসায় মনোনিবেশ ও পারিবারিক কারণে ড. জয়নুল আবেদিন ঐ সময়কার ইউরোপের সমৃদ্ধশালী দেশ গ্রীসে বসবাস শুরু করেন।
১৯৯০ সাল থেকে স্থায়ীভাবে এথেন্সে বসবাস করছেন গ্রীসের হাজার হাজার বাংলাদেশীর সবচাইতে কাছের মানুষ জয়নুল আবেদিন। ল্যান্ড অব ফিলোসফিতে নব্বই’র দশকে তাঁর নেতৃত্বেই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন গ্রীস’। গ্রীক প্রশাসনের কাছ থেকে সমীহ আদায় করে নেয়া প্রবল জনপ্রিয় এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনি। এথেন্সে বাংলাদেশ দূতাবাস প্রতিষ্ঠা সহ গ্রীস-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কোন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন কমিউনিটির এই প্রাণপুরুষ। দেশটিতে অর্থনৈতিক মন্দা চলাকালীন হতাশায় নিমজ্জিত দুর্দশাগ্রস্ত বাংলাদেশীদের সুখ-দুঃখের সার্বক্ষণিক সাথী ডক্টর আবেদিন। বর্ণবাদীদের হামলা থেকে স্থানীয় নিরীহ বাংলাদেশীদের বাঁচাতে বহুবার জীবনের ঝুঁকি নিতেও কার্পন্য করেননি তিনি। অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ এসোসিয়েশন (আয়েবা)’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনি।
ইউরোপ প্রবাসী বাংলাদেশীদের ভালোলাগা-ভালোবাসার সংগঠন আয়েবা’র প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি জেনারেল কাজী এনায়েত উল্লাহ। ঢাকার বনানীর ঐতিহ্যবাহী ‘চেয়ারম্যান বাড়ি’র চেয়ারম্যান পরিবারের এই কৃতি সন্তান ফ্রান্স সহ ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রিয়েল এস্টেট, রেস্টুরেন্ট ও এয়ারলাইন্স ব্যবসায় আকাশচুম্বি সাফল্যের অধিকারী। ‘বিজনেস ম্যাগনেট’ কাজী এনায়েত উজবেকিস্তান এয়ারওয়েজের ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের ‘জিএসএ’ হিসেবে কাজ করে আসছেন সাফল্যের সাথে। ফ্রান্স-বাংলাদেশ চেম্বার অব ইকোনমির সফল প্রেসিডেন্ট তিনি। ফ্রান্সের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বানিজ্যিক সম্পর্কের চলমান উত্তরণে সহায়ক শক্তি হিসেবে ফরাসী প্রশাসনের সাথে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে ফ্রান্স-বাংলাদেশ ইকোনমিক চেম্বার।
১৯৭৮ সাল থেকে প্যারিসে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন কাজী এনায়েত উল্লাহ। সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন তিনি। প্যারিস-ঢাকা ভিত্তিক বাংলাদেশ বিজনেস কনসালটিং (বিবিসি)’র ডিরেক্টর জেনারেল তিনি। ফ্রান্সের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে বাংলাদেশী পন্যের নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধানে এবং বাংলাদেশের রফতানীকারকদের বহুমুখী কল্যানে কাজ করছে বিবিসি। কনসালটিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর কার্যক্রম ইতিমধ্যে দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। কয়েক বছর আগে ফ্রান্স-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত সাড়াজাগানো চলচ্চিত্র ‘লাল টিপ’ এর সফল প্রযোজক কাজী এনায়েত উল্লাহ ফ্রান্স সহ ইউরোপের বাংলাদেশি কমিউনিটির কল্যানে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন বছরের পর বছর। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে সশরীরে অবস্থান করা ফ্রান্সের সাংবাদিক ফিলিপ আলফনসিঁর ভিডিও ফুটেজ ভিত্তিক ‘বাংলাদেশ : একটি পতাকার জন্ম’ এই বিশেষ প্রামাণ্যচিত্রেরও সার্থক প্রযোজক তিনি।
ডক্টর আবেদিন এবং কাজী এনায়েতকে আজ গোটা ইউরোপে এক নামে চেনেন জানেন সবাই। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের আরো বেশ ক’জন মেধাবী বাংলাদেশীকে সাথে নিয়ে মূলতঃ তাঁদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার সোনালী ফসল হিসেবেই ২০১২ সালের ডিসেম্বরে গ্রীসের রাজধানীতে আলোর মুখ দেখেছিল সর্বদেশীয় মহামিলনমেলা ‘আয়েবা গ্র্যান্ড কনভেনশন’। ইতিহাসের ঐ মাহেন্দ্রক্ষণে সেখান থেকেই যাত্রা শুরু হয় অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের। দেশে দেশে কমিউনিটির কল্যান নিশ্চিত করতে এবং প্রবাসীদের ন্যায্য অধিকার সুরক্ষায় কি দেশে কি প্রবাসে গত দুই বছরে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে অরাজনৈতিক ও অলাভজনক সংগঠন আয়েবা। বিস্তৃত নেটওয়ার্কে প্রযুক্তিকে কাজে লাগাবার পাশাপাশি দেশে দেশে সাধারণ প্রবাসীদের আরো কাছাকাছি পৌঁছানো গেলে ডক্টর আবেদিন এবং কাজী এনায়েতের বলিষ্ট নেতৃত্বেই আগামীতে ধরে রাখা সম্ভব কমিউনিটির কল্যানে বৈপ্লবিক অগ্রযাত্রা।