মাঈনুল ইসলাম নাসিম : উচ্চ আদালত এবং সরকার দলীয়দের ভাষায় ‘পলাতক আসামী’ অন্যদিকে সরকার বিরোধীদের দৃষ্টিতে ‘আগামীর দেশনায়ক’ – তারেক রহমান যেটাই হোন না কেন, আমাদের মাথাব্যথা তা নিয়ে নয়। ব্যক্তিবিশেষের বক্তব্য রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর প্রতীয়মান হলে এবং তা লাইভ টেলিকাস্টের অপরাধে রাষ্ট্রপক্ষ নিজেই বাদী হয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা করতে পারতো একুশে টিভির বিরুদ্ধে। প্রয়োজনে সাদা বা যে কোন রঙের পোশাক পরিহিত বাহিনী পাঠিয়ে বড় একটি তালাও ঝুলিয়ে দেওয়া যেতো কারওয়ান বাজারের জাহাঙ্গীর টাওয়ারে। কিন্তু তা না করে কথিত পর্নোগ্রাফির ‘আইওয়াশ’ মামলায় একুশে টিভির চেয়ারম্যানকে ফিল্মি স্টাইলে গ্রেফতার করে সরকার মূলতঃ আঘাত হেনেছে এক কোটি প্রবাসীর স্বার্থে।
দুই ডজনের বেশি টিভি চ্যানেলের ভিড়ে ‘একুশে টিভি’ বরাবরই অন্য যে কোন মিডিয়া হাউজের চেয়ে বেশি এগিয়ে ছিল প্রবাসী বাংলাদেশিদের অধিকার সংরক্ষণ এবং স্বার্থরক্ষায়। অথচ প্রবাসীদের কাছে প্রবল জনপ্রিয় এই চ্যানেলটির গলাটিপে ধরতে আজ উঠেপড়ে লেগেছে সরকারের অতি উৎসাহী একটি মহল। প্রবাসীদের জন্য আরো দুর্ভাগ্যজনক এই যে, একুশে টিভিকে আইনী জটিলতায় ফেলতে গত এক মাস ধরে ছক এঁকে যাচ্ছিলেন স্বয়ং প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী খোন্দকার মোশাররফ হোসেন। এই মন্ত্রনালয়ের সাথে নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানাচ্ছে, মাস দেড়েক আগে ‘একুশের রাত’ অনুষ্ঠানে সরকারের ভুল পলিসি ‘জি-টু-জি’র ব্যর্থতা সমূলে তুলে ধরায় একুশে টিভির উপর ‘যারপরনাই’ ক্ষিপ্ত হন প্রতাপশালী এই মন্ত্রী।
বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক একতরফাভাবে প্রবর্তিত গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট তথা জি-টু-জি পলিসির কারণেই জনশক্তি রপ্তানির চলমান ধ্বস – এমনটাই জানান দেয়া হয়েছিল সেদিন ‘একুশের রাত’ অনুষ্ঠানে। জি-টু-জি সফল না হবার নেপথ্য কারণ নিয়ে ঐ অনুষ্ঠানে খোলামেলা কথা বলেন প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য ইস্রাফিল আলম। মূল আলোচক হিসেবে তিনি সাফ জানিয়ে দেন, “জি-টু-জি ফলপ্রসু হয়নি। কাজের চেয়ে কথা বেশি হচ্ছে। আমলাতান্ত্রিক দায়িত্বহীনতা আছে। যারা দায়িত্বে আছেন তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে”। সরকার দলীয় সাংসদ হিসেবে ইস্রাফিল আলম কঠিন সত্য উচ্চারণ করে বসায় নাজুক অবস্থায় পড়েন মন্ত্রী খোন্দকার মোশাররফ। নিজ দলের সাংসদের বিরুদ্ধে কোন কুলকিনারা করতে না পেরে ব্যর্থতা ঢাকতে তিনি টার্গেট করেন একুশে টিভিকে।
জি-টু-জি’র ব্যর্থতার শ্বেতপত্র ‘একুশে টিভি’র বদান্যতায় জাতির সামনে তুলে ধরা, তাও আবার সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্যের স্বীকারোক্তিতে – সব মিলিয়ে শুধু ইমেজ নয়, রীতিমতো অস্তিত্ব সংকটের মুখে আজ মন্ত্রী খোন্দকার মোশাররফ। একুশে টিভিকে ফাঁসাতে নানান পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন মন্ত্রী। তার রোষানলে পতিত হবার আগেই অবশ্য লন্ডনে তারেক রহমানের বক্তব্যকে সরাসরি সম্প্রচারের অপরাধে ঘটলো অঘটন। মূলতঃ এ কারণেই প্রবাসীদের কাছে প্রবল জনপ্রিয় এই চ্যানেলের চেয়ারম্যান ও সিইও আবদুস সালামকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ‘আইওয়াশ’ হিসেবে এক্ষেত্রে সামনে আনা হয় পর্নোগ্রাফি প্রচারের হাস্যকর ও উদ্দেশ্যমূলক সব অভিযোগ, দেয়া হয় মামলা।
‘একুশের চোখ’ অনুষ্ঠানে পর্নোগ্রাফি প্রচার করার যে অভিযোগে ‘একুশে টিভি’র চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার করা হয়, সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে সচিত্র তথ্য-প্রমানাদির আলোকে ঐ অনুষ্ঠানটিতে মূলতঃ ভুক্তভোগী প্রবাসীদেরকে সচেতন করারই নান্দনিক প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়েছিল। অনুষ্ঠানের শুরুতেই উপস্থাপক ‘নিয়ম মেনে’ অনুরোধ জানান অপ্রাপ্তবয়স্ক দর্শকদের টিভি সেটের সামনে থেকে দূরে সরে যেতে। অপ্রিয় সত্য ঘটনাপ্রবাহে সাবলীলভাবে তুলে ধরা হয়, ইতালী প্রবাসী মাসুম (ছদ্মনাম) ২০০৩ সালে বাংলাদেশে বাবা-মা’র অমতে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন সঞ্চিতাকে (ছদ্মনাম)। বিয়ের ৫ বছর পর জীবিকার তাগিদে দেশ ছাড়ে মাসুম।
টানা ৬ বছর ইতালীতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রক্ত পানি করে যা উপার্জন করেছিলেন মাসুম, তার পুরোটাই পাঠান স্ত্রী সঞ্চিতার নামে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ইতালী থেকে মাসুমের পাঠানো লাখ লাখ টাকার পুরোটাই বছর জুড়ে অনৈতিক ফুর্তি করে উড়িয়ে দেয় বাংলাদেশে তার বিবাহিতা স্ত্রী সঞ্চিতা। বিপথগামী একাধিক যুবকের সাথে সঞ্চিতার বিভিন্ন সেক্স ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে ইন্টারনেটে, যা হয় সঞ্চিতার জ্ঞাতসারেই। ৬ বছর পর সম্প্রতি দেশে ফেরেন মাসুম। দেশে এক বন্ধুর কম্পিউটারে নিজের স্ত্রীর একাধিক সেক্স ভিডিও নিজ চোখে দেখে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে যেভাবে মাসুমের, ‘একুশের চোখ’ অনুষ্ঠানে ইনডিরেক্টলি এবং দূর থেকে তার খুব সামান্যই টাচ দেয়া হয় ঘটনার সত্যতা ঠিক রাখতে, সর্বোপরি মাসুমের মতো উদাসীন প্রবাসীদের সময়মতো সচেতন করতে।
‘একুশের চোখ’ ভিডিও প্রমাণাদি সহ আরো তুলে ধরে, এতোকিছুর পরও মাসুম চেয়েছিলেন সঞ্চিতাকে নিয়েই থাকতে। কিন্তু না, টাকা পয়সা হাতিয়ে নিয়ে উল্টো সঞ্চিতাই ডিভোর্স দেয় মাসুমকে। এখানেই শেষ নয়। সঞ্চিতা গং পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেয় ইতালী প্রবাসী এই যুবককে। ‘একুশের চোখ’ আদ্যোপান্ত অনুসন্ধানে একইসাথে জানান দেয় ঢাকার পুলিশের মজ্জাগত দুর্নীতির বিশেষ কিছু নেক্কারজনক চিত্র। বিয়ের পর টানা ৬ বছর স্ত্রীর কাছ থেকে দূরে থেকে পুরুষ হিসেবে ‘মহাপাপ’ কোন অংশেই যে কম করেনি মাসুম এবং দেশে দেশে আরো শত শত উদাসীন মাসুমদের সংসারে যখন ‘লালবাতি’ জ্বলতে বসেছে আজ, ‘একুশের চোখ’ দিয়ে কঠিন এই ম্যাসেজটিই দিতে চেয়েছে ‘একুশে টিভি’।
মাসুমের মতো যুবকরা এমন এক দেশে তাদের বিয়ে করা স্ত্রীদের রেখে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে, যেদেশে ঘরে ঘরে ছোবল দিয়েছে আজ হিন্দী সিরিয়ালের ভয়াবহ ভাইরাস। বাংলাদেশের অবস্থা আজ এমনই যে, “ছোট হোক বড় হোক, সংসার ভাঙ্গার জন্য দু’টি হিন্দি সিরিয়ালই যথেষ্ট”। ভুক্তভোগী কেউ কেউ এমনও বলে থাকেন, “তোমরা আমাকে একটি হিন্দি সিরিয়াল দাও, আমি তোমাদের একটি সফল পরকীয়া প্রেম উপহার দেবো”। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়া থেকে মাসুমদের বাঁচাতে ‘একুশে টিভি’ তার চোখে যা দেখেছে সেটাই প্রচার করার সৎসাহস দেখিয়েছে। পর্নোগ্রাফি নয় বরং হাজার হাজার ভুক্তভোগী প্রবাসীর চোখ-কান খুলে দিয়েছে আজ একুশে টিভি। প্রবাসীদের স্বার্থ বৈ অন্য কিছু দেখেনি ‘একুশের চোখ’। চেয়ারম্যান আবদুস সালাম, আপনাকে তাই লাল সালাম !