মানুষের সম্পর্ক স্থাপনে এবং নানা নতুন আইডিয়ার জন্ম দিতে ফেসবুক অন্যতম মাধ্যম। এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সদস্যরা আগের চেয়ে অনেক বেশি আন্তরিকতা নিয়ে আবেগপ্রসূত মানবিকতার চর্চা শুরু করছেন। ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার স্টাডি অব আমেরিকানস ইন্টারনেট হ্যাবিটস’ এর ২০১১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের দশ শতাংশের বেশি মানুষ আজ ফেসবুক নেশনের অংশ মনে করেন নিজেদের। তবে সাম্প্রতিককালে আমরা ফেসবুক নিয়ে নানা অভিযোগ শুনছি। প্রচুর অপকর্মের ঘটনার খবর পাচ্ছি যার উৎস ফেসবুক। তবুও মানুষের সঙ্গে স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়ার জন্য ফেসবুক আদর্শ মাধ্যম। ফেসবুকে যারা স্বাস্থ্যকর কার্যক্রম চালান এবং স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক বজায় রাখেন তাদের দশটি বৈশিষ্ট্য তুলে দেওয়া হলো।
১. তারা বেশি ছদ্মনাম ধারণ করেন না
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু মানসিক অবস্থা কাজ করে। মিডিয়া সাইকোলজিস্ট রবার্ট সিমারমন বলেন, একটি শিশুকে হাতুড়ি ধরিয়ে দিলে সে বাড়ি দেওয়া যায় এমন কিছু খুঁজে বেড়াবে। তেমনি এসব যোগাযোগমাধ্যমে ব্যবহারকারীদের নানা তথ্য জানার আগ্রহ সবার কাজ করে। আর সে কারণেই এখানে সবার মধ্যে তথ্য লুকোনোর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তবে পরবর্তীতে তা মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
২০১৩ সালে এক জার্মান গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সম্পর্ক স্থাপনের জন্য নয়, শুধুমাত্র ব্রাউজ করার জন্য ফেসবুকে প্রবেশ করেন, খুব দ্রুত তারা মানসিক অশান্তিতে ভুগতে শুরু করেন। তাই এখানে সত্য ও স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক গড়ে তোলা ভালো।
২. তারা FOMO অপেক্ষা JOMO পছন্দ করেন
দ্য ফিয়ার অব মিসিং আউট সংক্ষেপে ফোমো। মানুষের মধ্যে তার ফেসবুক ফিড না দেখতে পারার ভয় কাজ করে। তার বন্ধুরা হয়তো তাকে ছাড়াই কিছু করে ফেলেছে বা ঘুরতে গেছে ইত্যাদি সব সময় তাদের অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই পেরেশানি থেকে মুক্ত থাকেন যারা ‘দ্য জয় অব মিসিং আউট’ বা জোমো উপভোগ করেন। মাঝেমধ্যে কিছু এড়িয়ে চলা আমাদের স্বস্তির কারণ হয়।
৩. এটা যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নয়
নিউজ ফিডের মাধ্যমে খবর পাওয়া বা কাউকে একটা মেসেজ পাঠানো যতোটা সহজ, তাতে করে এর মাধ্যমেই তো যাবতীয় যোগাযোগের কাজটি সেরে ফেলা যায়। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। সম্পর্ক আরো সুন্দর ও উপভোগ্য করতে তারা ইমেইল পাঠান, চিঠি লিখেন বা মোবাইলে মেসেজ পাঠান। এর একেকটি মাধ্যমের একেকটি আবেদন রয়েছে।
৪. তারা সব বন্ধুদের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ করেন না
নিউজ ফিডে পাঁচশোর বেশি মানুষের আপডেট দেখাটা নিশ্চয়ই সম্ভব নয়। তাই সবার সঙ্গে প্রতিদিন যোগাযোগ রক্ষার প্রয়োজন পড়ে না।
মনোবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানী রবিন ডানবার জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে মানুষের মস্তিষ্কের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। গড়ে এর সংখ্যা মাত্র ১৪৮।
৫. অতিমাত্রায় সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে সচেতন তারা
যদি আপনার মনে হয় আপনি বন্ধুদের ওয়ালে অতিমাত্রায় সময় ব্যয় করছেন, তবে এখন সময় হয়েছে একটু ক্ষান্ত দেওয়ার। এ ক্ষেত্রে গুগল ক্রোম যারা ব্যবহার করেন তাদের সময় দেখার একটি ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া টাইম ম্যাগাজিন একটি সফটওয়্যার তৈরি করেছে যা দিয়ে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলার পর আপনি কতো সময় ব্যয় করেছেন তা বের করা যাবে। যারা সচেতনভাবে ফেসবুক ব্যবহার করেন, তারা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ফেসবুকে বিচরণ করেন।
৬. তাদের কাছে ফেসবুক স্বাস্থ্যকর বিতর্কের উৎস
যারা কাজের জন্য ফেসবুকে ব্যবহার করেন, তাদের দৃষ্টিতে এটি দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনার স্থান। ২০০৯ সালে এক গবেষণায় দেখা গেছে, একটি অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে ফেসবুকে মানুষের মতামত চাওয়া হলে তাতে বহু মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়। তাদের তর্ক-বিতর্ক আর আলোচনাতেই ঘটনাটি পরিষ্কার হয়ে যায়। আসলে ফেসবুকে মানুষের কাছে মতামত চাওয়া হলে সবাই তাতে সাড়া দেন। আর তারাই সাড়া দিয়ে থাকেন যারা ফেসবুককে মতামতের উৎস হিসেবে দেখেন।
৭. তারা সাধারণ সেটিং ব্যবহার করেন
ফেসবুকের গোপনীয়তার সেটিং খুবই জটিল। ২০১৩ সালে কার্নেগি মেলনের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ২০০৫ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত অসংখ্য ফেসবুক ব্যবহারকারী বহু তথ্য গোপন রাখতে চেয়েও তা রাখতে পারেননি। অর্থাৎ তাদের কাছে গোপনীয় রাখার বিষয়টি অনেক কঠিন। কিন্তু যারা সহজ-সরলভাবে নিজেদের কাজের জন্য ফেসবুকে থাকেন, তারা মূলত তাদের গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়ে মারাত্মভাবে সিরিয়াস নন।
৮. তারা উপলব্ধ করেন ফেসবুক বাস্তব জীবনের প্রতিফলন নয়
ফেসবুকের বন্ধু-তালিকায় যারা আছেন, সেখানে তাদের কার্যকলাপ কিন্তু তাদের বাস্তবজীবনের প্রতিচ্ছবি নয়। ফেসবুকে লাইক দেওয়া, ছবি আপলোড করা বা কমেন্ট দেওয়ার মাধ্যমে সবাই তার ভিতরকার আলোকিত অংশটাই দেখাতে চান।
সিমারমোন জানালেন, ফেসবুকের ভিন্ন অর্থে পলায়নের আরেক মাধ্যম। এখানে মানুষ নিজের কালো অংশ মুছে ফেলতে চায়। তার সঙ্গে কারো বন্ধুত্ব হলে নতুন বন্ধু তার সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে, তা মানুষকে নিজের বাজে দিকে থেকে পালাতে সহায়তা করে। কাজেই এখানে সত্য এবং মিথ্যের মধ্যে দাগ টানার ব্যবস্থা নেই।
৯. ফেসবুকে নিজেদের নেতিবাচক দেখলে তারা লগ অফ করেন
ফেসবুক ব্যবহারের সময় মানসিক অবস্থা বিষয়ে এক জার্মান গবেষণায় দেখা গেছে, অনেকে আছেন যারা অন্যদের চেয়েও ফেসবুকে অনেক স্বাবলীল এবং নিয়মিত, তবুও অনেকের চেয়ে হীনমন্যতায় ভোগেন। এ ক্ষেত্রে নিজেদের প্রবোধ দিতে তারা আরো ভালো কোনো পোস্ট দেন যার মাধ্যমে অন্যের কাছে নিজেকে বড় করে উপস্থাপন করা যায়। আর যারা স্বাস্থ্যকর ব্যবহারকারী অর্থাৎ, মূলত নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে ফেসবুকে থাকেন, তারা নিজেদের মিথ্যা প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করেন না। তাদের মধ্যে সেখানে থেমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
১০. তারা উপলব্ধি করেন ফেসবুকের চেয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে
২০১৩ সালে ২৬৩টি স্কুল, হাই স্কুল এবং কলেজের মধ্যে এক গবেষণায় দেখা যায়, বেশিরভাগ ছেলে-মেয়ে কাজ বা ক্লাশ শুরুর আগে পাঁচ মিনিট সময় পেলেই ফেসবুকে ঢুঁ মেরে নিচ্ছেন। এ পযায়ে তাদেরই পরীক্ষার ফলে ধস নামে। অন্যদিকে, আরো বেশ কয়েকজনের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা সামাজিকমাধ্যমে ঢুঁ মারার চেয়ে তার পড়ার কাজটিকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে উপলব্ধি করে এবং ওই কাজেই মনোবিবেশ করে। ফলে তাদের ফলও ভালো ছিলো। কাজেই এই ছাত্র-ছাত্রীরা ফেসবুকের স্বাস্থ্যকর ব্যবহারকারী। তারা ফেসবুকে অযথাই সময় নষ্ট করে না এবং এখানে তাদের কার্যকর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে।