মাঈনুল ইসলাম নাসিম : এথেন্সে দায়িত্বরত রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদের বিরুদ্ধে আইওএম-এর নারী দোভাষীকে দিয়ে তথাকথিত ‘যৌন কেলেংকারি’র অভিযোগ উত্থাপনের নেপথ্যে গ্রীসের মুখচেনা দালাল সিন্ডিকেট যে ভয়ংকর কূটকৌশল অবলম্বন করেছিল, তা উদঘাটিত হয়েছে অবশেষে। রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে বছরের শুরুতে আনীত ভূয়া ‘অডিও টেপ কেলেংকারি’র অভিযোগ গত মে মাসে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের তদন্তে মিথ্যা প্রমাণিত হবার পর আইওএম দোভাষীকে ম্যানেজ করে পাতা হয় নতুন ফাঁদ।
গ্রীসে আরো বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা থাকতে আইওএমকে কেন ‘বলির পাঁঠা’ বানালো সংঘবদ্ধ দালাল সিন্ডিকেট, তার কারণ সন্ধানে নেমে পড়েন এথেন্সের সচেতন বাংলাদেশিরা। ঢাকা, এথেন্স ও সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ব্যাপক অনুসন্ধানে তারা জানতে পারেন, জেনেভা ভিত্তিক আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন’ তথা আইওএম-এ ২০০১ থেকে ২০১২ সুদীর্ঘ ১১ বছর দেশে-বিদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন বর্তমান পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক। উক্ত ১১ বছর পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে ছুটিতে (লিয়েন) ছিলেন তিনি।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েসকে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশনার নিয়োগ দেয়া হলে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে শহিদুল হককে পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় তখন। গ্রীসের সুচতুর দালাল সিন্ডিকেট বর্তমান পররাষ্ট্র সচিবের আইওএম-এর সাথে নিবিড় সম্পৃক্ততার বিষয়টি অবগত হবার পরই রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদের বিরুদ্ধে এথেন্সের আইওএম দোভাষী লায়লা এন্টিপাসকে দিয়ে অভিযোগ দাড় করাবার পরিকল্পনা করে।
যেমন পরিকল্পনা তেমন কাজ, দায়ের হয়ে যায় ‘যৌন হয়রানির’ অভিযোগ। পার্টটাইম দোভাষী লায়লাকে আইওএম-এর ‘কর্মকর্তা’ দেখিয়ে শুরুতেই প্রতারণার আশ্রয় নেয় গ্রীসের দালাল সিন্ডিকেট। ষড়যন্ত্রকারীরা সজ্ঞানে নিশ্চিত ছিল, লায়লা এন্টিপাস তথা আইওএম-এর নাম ভাঙ্গিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করা হলে তা দিয়ে সহজেই প্রভাবিত করা যাবে বর্তমান পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হককে।
আইওএম-এর মতো প্রতিষ্ঠানে দেশে-বিদেশে তাঁর ১১ বছরের ক্যারিয়ারকে ঘিরে গড়ে ওঠা ইমেজ ও সেন্টিমেন্ট ষোলআনা কাজে লাগাবার ক্ষেত্রে সফলও হয় এথেন্সের দালাল সিন্ডিকেট। তার প্রমাণ- বিশ্বের নানা প্রান্তে বহু বাংলাদেশ দূতাবাসকে ঘিরে বছরের পর বছর সীমাহীন অভিযোগ থাকলেও দু’একটি দেশ ছাড়া তেমন কোথাও কোন তদন্ত টিম না পাঠিয়ে প্রায়োরিটি দেয়া হয় গ্রীসকে। অবশ্য এথেন্সের সাধারন বাংলাদেশিরা আন্তরিকভাবে স্বাগত জানায় ঢাকা থেকে আসা তদন্ত টিমকে, কারণ আর যাই হোক ভুক্তভোগীরা সামনাসামনি তাদেরকে বলার ও জানাবার সুযোগ পেয়েছেন ২০০৯ থেকে ২০১২ যেভাবে দূতাবাসকে পরিণত করা হয়েছিল লক্ষ লক্ষ ইউরোর ‘পাসপোর্ট বানিজ্যকেন্দ্র’ হিসেবে।
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের তদন্ত টিমের প্রতিবেদনে ‘দিনকে রাত’ ‘রাতকে দিন’ বানাবার জন্য দালাল-সিন্ডিকেট এখন উঠে পড়ে লেগেছে। এথেন্সের কমিউনিটির তরফ থেকে বারবারই বলা হয়েছে, ২০০৯-২০১২ গ্রীসে কাউন্সিলরের দায়িত্বে থাকা বিএম জামাল হোসেন এখন ঢাকা থেকে রীতিমতো ডিজিটাল স্টাইলে কলকাঠি নেড়ে যাচ্ছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে ‘কনস্যুলার এন্ড ওয়েলফেয়ার’ ইউনিটে ডিরেক্টর হিসেবে আছেন তিনি।
অভিযোগ আছে, এথেন্সে থাকাকালীন বিএম জামাল গ্রীসের আত্মস্বীকৃত দুই দালাল মিজানুর রহমান ও শেখ কামরুল ইসলামের সাথে যোগসাজশে পাসপোর্ট বানিজ্যের অভয়ারন্যে পরিণত করেন বাংলাদেশ দূতাবাসকে, কামিয়ে নেন কয়েক লক্ষ ইউরো। ২০১৩ সালের গোড়ার দিকে রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ এথেন্সে দায়িত্ব গ্রহন করার পর ছন্দপতন ঘটে তাদের সিন্ডিকেট সাম্রাজ্যে। কাউন্সিলর বিএম জামাল আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন আরো কিছুদিন গ্রীসে থাকতে, কিন্তু নয়া রাষ্ট্রদূতের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কাছে হার মানতে হয় তাকে।
ইচ্ছের বিরুদ্ধে ঢাকায় ফিরে যান বিএম জামাল এবং রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদের বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ মেটাতে বেছে নেন একের পর এক ষড়যন্ত্রের পথ। এথেন্সের দালালদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ বরাবরের মতো এখনো রক্ষা করে চলছেন তিনি। পাশাপাশি তদন্ত টিমের প্রতিবেদন রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদের বিরুদ্ধে নিতে বিএম জামাল ও তার সিন্ডিকেট আগেকার লুটপাটকৃত অর্থের একটি অংশ এখন ঢাকায় সুনির্দিষ্ট সেক্টরে বিনিয়োগ করছে, এমন অভিযোগও এথেন্সের বাংলাদেশ কমিউনিটির।