মাঈনুল ইসলাম নাসিম : কূটনীতিবিদ হিসেবে ৩৩ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার রাষ্ট্রদূত ইসমাত জাহানের। গত প্রায় ৬ বছর ধরে ব্রাসেলসে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি অত্যন্ত সফলতার সাথে। প্রখর মেধা বিশাল অভিজ্ঞতা আর বিশেষ যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে ইসমাত জাহান ইউরোপিয়ান কমিশন ও ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছেন। তাঁর ক্যারিশমেটিক ডিপ্লোমেসিতেই রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি পরবর্তী ইউরোপের বাজারে বড়সড় বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছে বাংলাদেশের প্রধান রফতানী খাত আরএমজি তথা তৈরী পোশাক শিল্প।
নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ণ ইস্যুতে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে অনেক আগে থেকেই সুপরিচিত ইসমাত জাহান বাংলাদেশের সবচাইতে সিনিয়র নারী কূটনীতিক। ২০০৯ সালে ব্রাসেলসে যোগ দেয়ার আগে তিন বছর নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির দায়িত্বে ছিলেন তিনি। জাতিসংঘের Committee on Elimination of Discrimination against Women (CEDAW)-এর সদস্য পদে ২০১৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়ে ইসমাত জাহান বাংলাদেশকে গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত করেন। নারীর প্রতি সহিংসতা বিলোপ বিষয়ক জাতিসংঘ কমিটি (সিডও) সদস্য পদে এর আগে ২০১১-২০১৪ প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে ইসমাত জাহানের দায়িত্বপালনকালীন সময়েই নিউইয়র্কে নিজস্ব ভবনে আলোর মুখ দেখেছিল বাংলাদেশ মিশন। অবশ্য ক্যারিয়ারের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সময়টি তিনি অতিবাহিত করেছেন ব্রাসেলসে। এখানে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে বাংলাদেশে ঘটে যায় তাজরীন দুর্ঘটনা এবং রানা প্লাজা ধ্বংসযজ্ঞের মতো ভয়াবহ বিপর্যয়। যৌক্তিক কারণে নড়েচড়ে বসে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। রাষ্ট্রদূত ইসমাত জাহানকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় তাদেরকে কনভিন্স করতে। অঘটন যাতে আর না ঘটে ভবিষ্যতে, সেলক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে সার্বক্ষণিক নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অসামান্য অবদান রাখেন বাংলাদেশের রফতানী বানিজ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষায়।
ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট ইসমাত জাহানের জন্ম ১৯৬০ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নেয়া শেষে ১৯৮২ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে যোগ দেন তিনি। পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন থেকে ল এন্ড ডিপ্লোম্যাসিতেও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন তিনি সাফল্যের সাথে। ওয়াশিংটনের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ‘ফেলো’ ইসমাত জাহান নেদারল্যান্ডসে (২০০৫-২০০৭) বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন ছাড়াও ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এবং বৈদেশিক বিভিন্ন মিশনে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বাংলাদেশের এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান ইসমাত জাহান। নানা খান বাহাদুর আবদুল গোফরান ছিলেন ‘বাংলার বাঘ’ শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সরকারের মন্ত্রী।
ইসমাত জাহানের বাবা এম ফজলুর রহমান ছিলেন তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান। মা এডভোকেট মেহেরুন্নেসা খাতুন প্রাদেশিক পরিষদে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচিত এমপি, যিনি ১৯৬১ সালে ঢাকা হাইকোর্টের প্রথম নারী আইনজীবি হিসেবে নিয়োগ পেয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবি সমিতির ফাউন্ডার প্রেসিডেন্ট ছিলেন এডভোকেট মেহেরুন্নেসা। তেমনি এক বংশের আলোকবর্তিকা হাতে আজ বাংলাদেশের এই সফল কূটনীতিক ইসমাত জাহান। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি ইস্যুতে ২০১৩ সালে ব্রাসেলসে একের পর এক জরুরী বৈঠকের ব্যস্ততায় মায়ের মৃত্যুর সময় পাশে থাকতে পারেননি বাংলাদেশের জন্য শতভাগ নিবেদিতপ্রাণ রাষ্ট্রদূত ইসমাত জাহান। দেশের প্রতি অকৃত্তিম ভালোবাসা আজ তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে বাবা-মা’র মতোই।