মাঈনুল ইসলাম নাসিম : জাভা সাগরে এয়ার এশিয়া বিমানের যতো যাত্রীর সলিলসমাধি হয়েছে বলে আশংকা কার হচ্ছে, গত দুই বছরে তার চাইতে বহুগুণে বেশি নিরীহ বাংলাদেশির সলিল সমাধি হয়েছে কক্সবাজার-টেকনাফ টু মালয়েশিয়া অবৈধ নৌ-রুটে। অনেক বাংলা মায়েরা এখনো পথ চেয়ে বসে আছেন যদিও তারা জানেন না আদরের সন্তানটি ফিরবে না আর কোনদিনই। বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী কল্যান আইনের নামে বাংলাদেশ সরকারের ভুল পলিসির খেসারতে একদিকে যেমন ধ্বংস হয়েছে শ্রমবাজার, তেমনি দিনকে দিন বেড়েই চলেছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে সাগর পাড়ি দেবার ভয়াবহ প্রবণতা।
সমুদ্রপথে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের পর এই তালিকায় নতুন সংযোজন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে চালু হওয়া নতুন এই রুটে কার্গোর মাধ্যমে অবৈধভাবে ব্যাপক হারে মানব পাচার শুরু হওয়ায় আমিরাতের শ্রমবাজারে আগে থেকেই তালাবদ্ধ দুয়ারে এবার একেবারে ‘সিলগালা’ লাগার আশংকা করছেন ঢাকা ও দুবাইয়ের অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। এই প্রতিবেদককে তাঁরা বলছেন, গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট তথা জি-টু-জি চালুর প্রেক্ষিতে রিক্রুটিং এজেন্টের মাধ্যমে বৈধভাবে জনশক্তি রপ্তানি বাংলাদেশ সরকার বন্ধ করে দেয়ার পরিণতিতেই মূলতঃ সমুদ্রপথে একের পর এক খুলছে অবৈধ নতুন নতুন রুট।
অভিবাসন নিয়ে ব্যাপক গবেষণাধর্মী কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বাংলাদেশের বেসরকারী প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি রিসার্চ মুভমেন্ট (রামরু)’র চেয়ারম্যান ড. তাসনীম সিদ্দিকী অতি সম্প্রতি জানিয়েছেন, ২০১৪ সালে বিদেশে বাংলাদেশের কোন শ্রমবাজার খোলেনি। অথচ সরকারের তরফ থেকে একের পর এক শ্রমবাজার খোলার সুসংবাদ জানান দেয়া হয়েছে কয়েক দিন পরপরই। অন্যদিকে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করছে, জি-টু-জি চালুর পর বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নেপাল, শ্রীলংকা, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া সহ আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ পুরোদমে দখলে নিয়েছে বিভিন্ন দেশের বিশাল শ্রমবাজার।
প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়ের সাথে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের কাজের সমন্বয়হীনতার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস সমূহের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্বহীনতা খামখেয়ালীপনা ও উদাসীনতা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করায় নতুন শ্রমবাজার খোলা দূরের কথা, বরং বাংলাদেশের জন্য একের পর এক নতুন নতুন তালা ঝুলতে শুরু করেছে বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজারে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক দূরত্ব হ্রাসে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে চেষ্টা থাকলেও সাফল্য আসছে না। শুধু এক এক্সপোতে দুবাইকে ভোট না দিয়ে রাশিয়াকে ভোট দেবার মাশুল হিসেবে রীতিমতো ‘লালবাতি’ জ্বলে গেছে আমিরাতের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে।
এক্সপো ভোটাভুটিতে বাংলাদেশের প্রত্যাশিত ভোট না পেয়ে ‘যারপরনাই’ নাখোশ হয় আমিরাত প্রশাসন। প্রতি বছর এক লাখ করে তিন বছরে বাংলাদেশ থেকে তিন লাখ কর্মী নেয়ার যে পরিকল্পনা আমিরাত সরকারের ছিল, তাৎক্ষণিকভাবে তা তারা পুরোটাই তুলে দেয় নেপালের হাতে। এক্সপোতে বাংলাদেশের ভোট না পেলেও নেপালের ভোটটি ঠিকই পেয়েছিল দুবাই। ইতিমধ্যে ২০১৪ সালে প্রায় লাখখানেক নেপালী কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে আমিরাতে। অথচ বাংলাদেশের প্রাপ্তি শূন্য। একই বছর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আমিরাত সফর করলেও দূর হয়নি এক্সপোর ক্ষত, খোলেনি শ্রমবাজার।
একসময় বাংলাদেশ থেকে সবচাইতে বেশি কর্মী যেতো সৌদি আরবে। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু)’র তথ্য মোতাবেক, ২০১৪ সালে মাত্র ১০ হাজার বাংলাদেশি সৌদি আরব গেছেন কাজের উদ্দেশ্যে। অথচ বাংলাদেশ থেকে বহুগুণ বেশি কর্মী কিন্তু সৌদি আরব ঠিকই নিয়েছে অন্যান্য দেশ থেকে। সৌদির মতো অবস্থা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও। মালয়েশিয়া সরকার ভদ্রতার খাতিরে বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে একের পর এক প্রতিশ্রুতি দিলেও বাংলাদেশ থেকে কর্মী না নিয়ে অন্যান্য দেশ থেকে যথারীতি লাখ লাখ কর্মী নিয়েছে ২০১৪ সালে।
নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টিতে সরকারের কূটনৈতিক দুর্বলতা এবং বায়রা তথা রিক্রুটিং এজেন্টদের মাধ্যমে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর সুযোগ না থাকাটাই জনশক্তি রপ্তানিতে ধ্বসের প্রধাণ কারণ হলেও আত্মঘাতী পলিসি জি-টু-জিকে আরো বেশি উৎসাহিত করার দুর্ভাগ্যজনক ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সরকারের আগের টার্মের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ৫টি বছর সারা পৃথিবী চষে বেড়ালেও নতুন শ্রমবাজারের নাগাল পাননি। বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর আজীবন কূটনীতিক হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকলেও পেশাদার রাজনীতিবিদ না হবার কারণে হাত-পা বাঁধা থাকায় সরকারের পলিসি মেকিংয়ে কোন ভূমিকা রাখতে পারছেন না বলে জানা গেছে।
প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী খোন্দকার মোশাররফ হোসেন মন্ত্রীসভায় ‘বিশেষ’ কারণে ‘অস্বাভাবিক’ প্রভাবশালী হওয়ায় বরাবরই রয়ে গেছেন যে কোন প্রকার জবাবদিহিতার উর্ধ্বে। বিশ্বের ১৭০টি দেশে সরকার জনশক্তি রপ্তানি করছে – এমন তথ্য তিনি প্রায়শঃই দিয়ে থাকেন তার অফিসে সাংবাদিকদের ডেকে, এমনকি জাতীয় সংসদেও। মন্ত্রীর এমন বিভ্রান্তিকর তথ্য হাসির খোরাক হয়েছে ১ মিলিয়ন বাংলাদেশি অধ্যুষিত ইউরোপে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহে বাংলাদেশ থেকে কবে কখন কোন রুটে কিভাবে সরকার কি পরিমাণ জনশক্তি রপ্তানি করেছে এবং করছে তার কোন তথ্যউপাত্ত দিতে পারেননি গত ৬ বছর দায়িত্বে থাকা এই মন্ত্রী।
জনশক্তি রপ্তানির ধ্বসের চিত্র ঢাকতে বিএমইটি’র মাধ্যমে সরকারের নতুন জালিয়াতির তথ্যও সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। মালদ্বীপের বহির্গমন ছাড়পত্র নিয়ে অনেকেই অবৈধভাবে মালয়েশিয়া ও লিবিয়াতে পাড়ি জমাচ্ছেন অথচ এইসব লোকদের নামও জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান তালিকায় উল্লেখ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জি-টু-জি’র মাধ্যমে বছরে এক লাখ লোক যাবে মালয়েশিয়ায় এবং পাঠানো হবে মাত্র ৩৩ হাজার টাকায় এমন কথা বলে দু’বছর আগে রাষ্ট্রের সাড়ে ৭ কোটি টাকা জলে ঢেলে সাড়ে ১৪ লাখ লোককে নিবন্ধন করানো হলেও গত ২৪ মাসে মালয়েশিয়া পাঠানো হয়েছে মাত্র হাজার পাঁচেক কর্মী।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রা বলছে, জি-টু-জি বহাল রাখা হলে শ্রমবাজারের এই ধ্বস দিনকে দিন আরো ধ্বংসাত্মক রূপ ধারণ করবে। অভিবাসন খরচ কমানোর নামে সরকারের ভুল পলিসি জি-টু-জি’র সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি রেমিটেন্সের ওপর, এমন আশংকা আজ অর্থনীতিবিদদের। বিএমইটি’র পরিসংখ্যান অনুসারে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে যে প্রায় ৪ লাখ কর্মী বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন, তাদের আড়াই লাখই হচ্ছেন নারী কর্মী। অথচ জি-টু-জি’র বাধ্যবাধকতা না থাকলে শুধু মালয়েশিয়াতেই ২০১৪ সালে অন্ততঃ ৮ লাখ বাংলাদেশির কর্মসংস্থান হতে পারতো বলে জানান অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। দেশের স্বার্থে ২০১৫ সালে সম্ভাব্য আরো ধ্বস ঠেকাতে সরকারের ঘুম ভাঙ্গবে কি ?