মাঈনুল ইসলাম নাসিম : ইতালির বানিজ্যিক রাজধানী মিলানে অনুষ্ঠিত আসেম সামিটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহন সফল ও সার্থক হতে দেখে যতটা না তৃপ্ত হয়েছিলাম, ২৩ অক্টোবর বৃহষ্পতিবার ঢাকায় আয়োজিত ‘প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন’-এ সাংবাদিক সমাজের কিছু গুণীজনদের চাটুকারিতার তৈলাক্ততায় তিক্ত-বিরক্ত হয়েছি ঠিক ততোটাই। ইউরোপের সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক তথা ব্যবসা-বানিজ্য আমদানি-রফতানি বিশেষ করে ইউরোপিয় ইউনিয়নের বাজারে আশংকাজনভাবে বাংলাদেশের রফতানির প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া এবং উত্তরণে করণীয় নিয়ে উপস্থিত সাংবাদিকরা ‘টু-শব্দ’টিও উচ্চারণ করেননি সংবাদ সম্মেলনে।
প্রতিবার বিদেশ সফরের পর গনভবনে সাংবাদিকদের ডেকে খোলামেলা কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রশংসাভাজন হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু মুখচেনা কিছু চাটুকার সাংবাদিকের ‘যারপরনাই’ তোষামোদিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই ধরণের সংবাদ সম্মেলনের ‘কোয়ালিটি’ আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তা কি তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরীর মতো প্রবীন অভিজ্ঞ সাংবাদিক একটিবারও ভেবে দেখেছেন ? এক ঘন্টার সংবাদ সম্মেলনে প্রায় অর্ধেক সময় সাংবাদিকরা সুযোগ পেয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করার। লাইভ টেলিকাস্টের সুবাদে সারা বিশ্বের বাংলাদেশিদেরও সুযোগ হয় ঢাকার সাংবাদিকদের জঘন্য চাটুকারিতা চোখ দিয়ে দেখার ও কান দিয়ে শোনার।
ইউরোপিয় ইউনয়নে বাংলাদেশের বাজার যেখানে ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে পাকিস্তান ও শ্রীলংকা, যেখানে ইইউ তাদের জিএসপি স্কিম সংস্কারের কারণে বাংলাদেশের ৭টি রফতানি পন্য কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, জিএসপি স্কিম রিভিউর কারণে পাকিস্তান ও শ্রীলকা বাড়তি সুবিধা লাভ করায় যেখানে এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের ওপর – এসব নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে একটি প্রশ্ন করারও সৌভাগ্য হয়নি ঢাকার প্রেস ওয়ার্ল্ডের রথি-মহারথিদের। ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের শীর্ষ নেতাদের সাথে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বানিজ্য ঘাটিতির চলমান সংকট উত্তরণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কোন আলোচনা করেছেন কি-না, তা বাংলাদেশের জনগনের জানার সুযোগ হলো না ধান্ধাবাজ প্রশ্নকারীদের কারণে।
প্রশ্নোত্তর পর্বের প্রায় অর্ধেক সময় আটকে যায় ১০ মাস আগে হয়ে যাওয়া ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন ইস্যুতে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কারো কারো প্রশ্নাবলী ও প্রশ্ন করার ভঙ্গিমায় মনে হয়েছে যেন শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক জঙ্গীবাদ মোকাবেলা করতেই ইতালিতে আসেম সম্মেলনের ডাক দেয়া হয়েছিল। কারো আদালতে হাজিরা না দেয়ার জন্যই কি হরতাল ডাকা হলো – এমন প্রশ্নের সাথে আসেম সম্মেলনে বাংলাদেশের সাফল্য বা অর্জনের কী যোগসূত্র তা হয়তো জানতেন না প্রশ্নকারী নিজেও। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, সংবাদ সম্মেলনের বিষয়বস্তু গোল্লায় যাক, গনভবনে যখন ঢুকেছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা চাই। সংবাদ সম্মেলন হচ্ছে ইতালি সফরকে ঘিরে অথচ একজনতো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেই বসলেন, তিনি কি কি সম্ভাবনা নিয়ে দুবাই সফরে যাবেন।
বিদেশ সফর পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিক নামধারী কতিপয় চাটুকারের তোষামোদীর তৈলচিত্র অবলোকন এবারই প্রথম নয়। প্রায় প্রতিবারই নেক্কারজনক এই পারফরম্যান্সটি শো করে আসছেন তারা রীতিমতো মার্কামারা স্টাইলে। ইতালি সফরের আগে জাতিসংঘের সাধারন অধিবেশনে যোগদান শেষে নিউইয়র্ক থেকে ফেরার পর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের চাটুকারিতা ছিল আরো লজ্জাস্কর। তোষামোদীতে অতীতের সব রেকর্ড ব্রেক করেন সেদিন বাংলাদেশের ট্রেড মার্কড জার্নালিস্ট সোসাইটি। যারা লাইভ দেখেছেন তাদের অনেকের কাছে সেটিকে অনেকটা ‘পার্টি ওয়াকিং সেশন’-এর মতোই মনে হয়েছিল বারে বারে।
বিষয়ভিত্তিক আলোচনা বা প্রশ্নোত্তর নিশ্চিত না করে সংবাদ সম্মেলনের প্রায় পুরোটা সময় যদি জুড়ে থাকে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন, অংশ না নিয়ে কার লাভ কার ক্ষতি কতটা হলো, সন্ত্রাস দমন ও জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় সরকারের সাফল্য, চিরাচরিত স্টাইলে বিরোধী দলের অতীত আমলনামা পর্যালোচনা – সেক্ষেত্রে এই ধরণের সংবাদ সম্মেলন মাসের যে কোন সময়ইতো হতে পারে, বিদেশ থেকে ফিরেই কেন ? গুরুত্বপূর্ণ যে কোন বিদেশ সফরের ওপর আয়োজিত ‘প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন’-এ অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নাবলী কতটা অবান্তর, তা গনভবনের কার্ডধারী সাংবাদিকরা কেন বুঝেও না বোঝার ভান করছেন ?
তোষামোদী ও চাটুকারীতার স্বার্থে সাংবাদিকদের পেশাদারীত্বের মাথা খাওয়ার এই খেলা আর কতকাল ? অবস্থাদৃষ্টে ইদানিং মনে হয়, অযৌক্তিক তোষামোদী করতে যারা প্রস্তুত নন, গনভবনের মাইক্রোফোন সম্ভবতঃ তাদের হাতে যেতেও প্রস্তুত নয়। অবাধ তথ্যপ্রবাহের এই যুগে স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই পারেন তাঁর সংবাদ সম্মেলনের জৌলুস ধরে রাখতে। বিদেশ সফর যেখানে সফল ও সার্থক হচ্ছে, সেখানে গনভবনের এই সুন্দর আয়োজনটি অসুন্দরদের হাত থেকে বাঁচালে উপকৃত হবে জনগন, এগিয়ে যাবে দেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার হারাবার কিছু নেই। চাটুকারদের গনভবনের চারদেয়ালের বাইরে রাখলে ক্ষতি কি ?