‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে নিজেকে সামলে একবাক্যের রিপ্লাইতে ভদ্রলোককে শুধু এটুকুই বললাম, ‘‘আপনি আমার শুভাকাঙ্খি তাই রোজা-রমযানের দিন তর্কে যেতে চাই না, তবে মিস্টার রেমিটেন্স ও মিস্টার জি-টু-জি’র মধ্যকার সাম্প্রতিককালে ফাঁস হয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক স্কাইপ সংলাপের চুম্বক অংশটি আপনাকে ফরোয়ার্ড করছি, পারলে মন্ত্রী মহোদয়কে পড়ার সুযোগ করে দেবেন’’। ইস্কাটন গার্ডেনে গিয়ে পড়ে শোনাবেন, কথা দিলেন তিনি। তাই পাঠক চলুন দেখা যাক, কী ছিল সেই বহুল আলোচিত সংলাপে –
মি. রেমিটেন্স : মন্ত্রী মহোদয়ের একগুয়েমিই শুধু নয়, বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিতে ধ্বস নামার জন্য একমাত্র কেবলমাত্র শুধুমাত্র দায়ী ইঞ্জিনিয়ার খোন্দকার মোশাররফ হোসেনের অদূরদর্শীতা, উদাসীনতা, খামখেয়ালীপনা ও দায়িত্বহীনতা। জনশক্তি রপ্তানির বাজারে ধ্বস নামিয়েছে সরকারের ‘জি-টু-জি’ পলিসি।
মি. জি-টু-জি : কী বলছেন এসব ? গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট (জি-টু-জি) পলিসি প্রয়োগ করে মন্ত্রী মহোদয়তো বিদেশগামী যাত্রীদের হয়রানি শূন্য পেরিয়ে মাইনাসের কোঠায় নামিয়ে এনেছেন। রিক্রুটিং এজেন্ট আই মিন আদম বেপারিদের ঘুম হারাম করে বেয়াই সাহেব আজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আরো বেশি কাছের মানুষ হয়েছেন।
মি. রেমিটেন্স : মুখ সামলে কথা বলুন ব্রাদার ! কাদের আপনি আদম বেপারি বলছেন ? দু’চারজন মন্ত্রী দুর্নীতি করেন বলে সবাই কি দুর্নীতিবাজ ? গুটিকয়েক রিক্রুটিং এজেন্ট নিরীহ লোকদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, পারলে তাদেরকে ঝুলিয়ে দিন। মনে রাখবেন, রেমিটেন্সের উৎস শুধু প্রবাসীরাই নন, রিক্রুটিং এজেন্ট তথা আপনার ঐ আদম বেপারিরাও কিন্তু রেমিটেন্স কৃতিত্বের সমান অংশীদার। শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-ক্রীড়াবিদদের পাশাপাশি সফল রিক্রুটিং এজেন্টদেরকেও কিন্তু সব ধরণের জাতীয় পুরষ্কারে ভূষিত করতে হবে।
মি. জি-টু-জি : কথাতো মন্দ বলেননি ভাই সাহেব, তবে ইঞ্জিনিয়ার মশাই কিন্তু ভিশন রাগী মানুষ। উনি অনেক জ্ঞানী-গুণী, কারো পরামর্শের প্রয়োজন কোনদিনই অনুভব করেননি তাঁর বর্নাঢ্য ক্যারিয়ারের পথচলায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকটাত্মীয় বলেই শুধু নন, একজন প্রতাপশালী মানুষকে চটিয়ে আপনার কি লাভ বলুন। মন্ত্রী মহোদয় কিন্তু একসময় জাতিসংঘে চাকরি করতেন।
মি. রেমিটেন্স : বাহ ! খুব ভালো বলেছেন। জ্ঞানপাপীদের জন্যই তাহলে বৈদেশিক শ্রমবাজারে আজকের এই ধ্বস ! ‘গ্লোবাল ম্যানপাওয়ার রিয়েলিটি’ আর ‘ইউনাইটেড ন্যাশন্স’ কিন্তু এক জিনিস না ভাইজান ! জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)’র চাকরির অভিজ্ঞতার রীতিমতো অপব্যবহার করেছেন মন্ত্রী বাহাদুর ইস্কাটন গার্ডেনে বসে।
মি. জি-টু-জি : তাই নাকি ? আপনার কাছে কোন তথ্য-উপাত্ত আছে ? মন্ত্রণালয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে কিন্তু বরাবরই বলা হচ্ছে, দিনকে দিন মাসকে মাস বছরকে বছর জনশক্তি রপ্তানি আশাব্যঞ্জক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মি. রেমিটেন্স : দিনকে যেমন চাইলেই রাত বানিয়ে ফেলা যায় না, তেমনি শাক দিয়ে ঢাকা যায় না মাছ। ২০১২ সালে ৬ লাখ ৭ হাজার ৭৯৮ জন কর্মী বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন অথচ ২০১৩ সালে তা হ্রাস পেয়ে হয় ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৪০৯ জন। অর্থাৎ ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে জনশক্তি রপ্তানি কমেছে শতকরা ৩০ ভাগেরও বেশি। ‘জি-টু-জি’র মতো সরকারের ভুল পলিসি, মন্ত্রী মশাই’র একগুয়েমি সব মিলেমিশে একাকার হয়েই এই মহাধ্বস।
মি. জি-টু-জি : তবে ভাই যাই বলেন, রেকর্ড পরিমাণ রিজার্ভ মানি এখন আমাদের। সরকারী তথ্যবিরনী অনুযায়ি, রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ছে বৈ কমছে না। মন্ত্রী মহোদয় কিন্তু বলেছেন, জি-টু-জি’র সুফল হিসেবেই দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে রেমিটেন্স। তিনি কি সঠিক বলেন নি ?
মি. রেমিটেন্স : জ্বি জনাব, তিনি বেঠিক বলেছেন। বাস্তবতার মুখোমুখি হতে লজ্জা কিসের ? একসময়ের ধনাত্মক রেমিটেন্স আজ ঋণাত্মক রূপ ধারণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানই বলছে, ২০০৩ সালে প্রবাসীরা দেশে প্রেরণ করেন ৩.১৮ বিলিয়ন ডলার, ২০০৪ সালে ৩.৫৭, ২০০৫ সালে ৪.২৯, ২০০৬ সালে ৫.৪৮, ২০০৭ সালে ৬.৫৬, ২০০৮ সালে ৮.৯৮, ২০০৯ সালে ১০.৭২, ২০১০ সালে ১১.০০ এবং ২০১১ সালে ১২.১৭ বিলিয়ন ডলার। রেমিটেন্স প্রবাসের ইতিহাসে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রেকর্ডটি সৃষ্টি হয় ২০১২ সালে ১৪.১৬ বিলিয়ন ডলার আহরণের মধ্য দিয়ে।
মি. জি-টু-জি : তাহলেতো মন্ত্রী মহোদয় ঠিকই বলেছেন। বছরে বছরে বেড়েছে রেমিটেন্স।
মি. রেমিটেন্স : মাইন্ড করবেন না মিয়াভাই, আসলে এটা আপনাদের রক্তের দোষ। মধ্যরাতের টকশো’র মতো কথা শেষ না করতেই মাঝখান দিয়ে …! ২০১২ সালের পর কি ঘটলো তা কি জানার বা শোনার প্রয়োজন মনে করলেন না ! ২০১২ সালের তুলনায় আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের রেমিটিন্স ২০১৩ সালে না কমলেও কমেছে বাংলাদেশের। ২০১২ সালের আমাদের ১৪.১৬৩ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড রেমিটেন্স ২০১৩ সালে ১২.৬২১ বিলিয়নে এসে ঠেকে। ‘টেন পারসেন্ট লেস রেমিটেন্স ফ্লো’ অর্থাৎ ১ বছরের ব্যবধানে শতকরা ১০ ভাগ রেমিটেন্স হ্রাস পাবার জন্য সর্বাগ্রে দায়ী বাংলাদেশ সরকারের কুখ্যাত ‘জি-টু-জি’ পলিসি।
মি. জি-টু-জি : পরিসংখ্যানতো দেখি ঠিকই কথা বলছে ওস্তাদ ! বুঝলাম, ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের প্রকৌশলবিদ্যা কোন কাজে লাগেনি বিদেশে আমাদের জনশক্তির নতুন নতুন বাজার সৃষ্টিতে। বহুদিন ধরে যা ছিলো তাওতো দেখছি যায় যায়। একটি বিষয় একটু খোলাসা করে বলেনতো ওস্তাদ, ‘জি-টু-জি’ পলিসির ব্যাপারে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সরকারের ভূমিকাটা কি ?
মি. রেমিটেন্স : ভাগ্যিস, সারা রাত রামায়াণ পড়ে সকালে জিজ্ঞেস করলেন না সীতা কার বাপ। অবশেষে অরিন্দম …! মিয়াভাই আমার লাইনে আসলেন, কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে ! ও আচ্ছা, আসলে বাংলাদেশ সরকারের ভূয়া ‘জি-টু-জি’ পলিসি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশেরই কিন্ত ন্যূনতম কোন মাথাব্যথা নেই। কারণ বিভিন্ন দেশের রিক্রুটিং কোম্পানিগুলোই শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের বিশাল শ্রমবাজার। গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট (জি-টু-জি)’র বাধ্যবাধকতার কারণে বিদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বহুদিনের অভ্যস্ততা তথা বাড়তি বেনিফিট থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের কপোলে। বেয়াই সাহেবে তথা বাংলাদেশ সরকারের চাপিয়ে দেওয়া বিধ্বংসী এই পলিসি বাংলাদেশের জন্য যতো বড় আত্মঘাতী, সঙ্গত কারণে বাইরের কোম্পানিগুলো ঠিক ততোটাই বিশাল বুড়ো আঙ্গুল আমাদের দেখিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশ থেকে।
মি. জি-টু-জি : মন্ত্রী মহোদয়কে নিয়ে আপনার সাথে আমার এই সিক্রেট আলাপ যাতে ঘুনাক্ষরেও কেউ জানতে না পারে। জায়গা মতো জানলে আমার কিন্তু ইস্কাটন গার্ডেনে যাওয়াই বন্ধ হয়ে যাবে। রুটি-রুজি বলে কথা।
মি. রেমিটেন্স : ইস্কাটন গার্ডেনে আপনার কেন যাতায়াত বা সেখানে করেনটা কি – এই প্রশ্ন করে আমার ভাইজানকে বিব্রত করতে চাই না। তবে একটা জিনিস মনে রাখবেন, বেয়াই সাহেব নিজেই কিন্তু জানেন তিনি কী ভুল করেছেন, কী সর্বনাশ তিনি ডেকে এনেছেন আমাদের ম্যানপাওয়ার মার্কেটে। তাছাড়া ওনারতো বয়সও হয়েছে মাই ডিয়ার! ফিজিক্যাল ফিটনেসের একটি ব্যাপরতো আছেই। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের গুরুদায়িত্ব পালনে বাংলাদেশের প্রয়োজন আজ মি. শাহরিয়ার আলম সাহেব বা মি. পলক সাহেবের মতো প্রাণচঞ্চল ‘স্মার্ট এন্ড স্কিল্ড’ মিনিস্টার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পারেন দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়ে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে শিক্ষা বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিতে। আর যাই হোক, সব কুলই তাতে রক্ষা হয়।
মি. জি-টু-জি : সেহরীর সময় যায় যায়। এখন সরকারের কী করণীয় সেটা বলুন। সামনে ঈদ। গনভবনে অনেকের সাথে আমিও যাচ্ছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে। সরাসরি ওনাকেতো আর কিছু বলতে পারবো না, তবে আমার বিশ্বস্ত লোক মারফত বঙ্গবন্ধু কন্যার কানে যে কোন মূল্যে আপনার কথা পৌঁছাবো, কথা দিচ্ছি।
মি. রেমিটেন্স : জ্জি, ধন্যবাদ দিয়ে আপনাকে ছোট করতে চাই না। প্যালেস্টাইনে ইহুদী আগ্রাসনের বিভীষিকাময় এই সময়ে কাউকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে আমার রুচিতে বাঁধে, তবে বঙ্গবন্ধু কন্যাকে আমার সালাম ও শুভেচ্ছার পাশাপাশি শুধু এই আকুতিই পৌঁছে দেবেন, তিনি যাতে একটু নড়েচড়ে বসেন। রেমিটেন্সের দোহাই দিয়ে বলবেন, ‘‘মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তির তালাবদ্ধ দুয়ারের চাবি কিন্তু আপনার হাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ! জি-টু-জি বাতিল করুন। সেগুনবাগিচা ও ইস্কাটন গার্ডেনে এসে মাঝেমধ্যে অফিস করুন। আপনার একটু ঘষামাজায় আলো জ্বলে উঠতে পারে মধ্যপ্রাচ্যে। আরব দেশগুলোর সাথে শীতল সম্পর্কের দিন শেষ হওয়া চাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনিতো সবই হারিয়েছেন, নতুন করে হারাবার কিছু নেই। দিয়েছেন অনেক কিছুই দেশকে। আপনিই পারেন হাতের চাবিটি ব্যবহার করে শ্রমবাজারের বদ্ধ দুয়ারের তালাটি খুলে দিতে’’।