মাঈনুল ইসলাম নাসিম : প্রায় ১২ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ স্পেনিশ ভাষাভাষী দেশ মেক্সিকোতে দু’বছর আগে বাংলাদেশ দূতাবাসের কার্যক্রম শুরু হবার পর থেকে ক্রমশঃ জোরদার হচ্ছে দু’দেশের মধ্যকার অর্থনৈতিক ও বানিজ্যিক সম্পর্ক। বাংলাদেশ সরকারের ‘ইকোনমিক ডিপ্লোমেসি’ পলিসিতে বাড়তি ‘ডায়নামিজম’ আনার অংশ হিসেবেই মেক্সিকো সিটিতে দূতাবাস কাজ করে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত এম ফজলুল করিম।
২৭ জুন শুক্রবার এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘‘মেক্সিকোর সাথে বাংলাদেশের বানিজ্যিক ভারসাম্য তথা ব্যালেন্স অব ট্রেড আমাদের খুবই অনুকূলে এবং এখানে বাংলাদেশি পন্যের বাজার বহুমূখী সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আমরা সাফল্যের সাথে অগ্রসর হচ্ছি।’’ ঝানু কূটনীতিক এম ফজলুল করিম গত বছর জুনে মেক্সিকোতে দায়িত্ব গ্রহণের আগে জর্ডান, সৌদি আরব ও ইতালিতে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।[sociallocker]
২০১২ সালের জুলাইতে দূতাবাস প্রতিষ্ঠিত হলেও গত নভেম্বর থেকে নিজস্ব ভবনে কাজ শুরু করে বাংলাদেশ দূতাবাস। এর আগে প্রথম সোয়া ১ বছর প্রথমে হোটেল কক্ষে, পরে কাউন্সিলরের বাসায় এবং পরবর্তিতে আবার হোটেল থেকে পরিচালনা করতে হয় দূতাবাসের কার্যক্রম। দেরিতে হলেও গত ৮ মাস ধরে মেক্সিকো সিটির ডিপ্লোম্যাটিক জোনে নিজস্ব ভবনে উড়ছে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। রাষ্ট্রদূত এম ফজলুল করিমের সাথে কাউন্সিলর হিসেবে আছেন হারুন আল রশিদ।
পুরো মেক্সিকোতে সর্বসাকুল্যে মাত্র ২শ’ বাংলাদেশির বসবাস হলেও দেশটিতে অত্যন্ত আশাব্যাঞ্জক রফতানী বানিজ্য বাংলাদেশের। এদেশে অর্থবছর গণনা করা হয় জানুয়ারি টু ডিসেম্বর। সে হিসেবে ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ১২ মাসে বাংলাদেশ থেকে মেক্সিকোতে এসেছে ২০৪ মিলিয়ন ইউএস ডলারের পন্য। এর মধ্যে শতকরা নব্বই ভাগ অর্থাৎ ১৮৪ মিলিয়ন ইউএস ডলারই হচ্ছে আরএমজি বা গার্মেন্টস সামগ্রী। বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া বাকি ১০ ভাগ পন্যের মধ্যে রয়েছে পাটজাত পন্য, চামড়া ও ভেজিটেবল অয়েল।
অন্যদিকে মেক্সিকো থেকে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ আমদানি করেছে মাত্র ২১ লাখ (২.১ মিলিয়ন) ইউএস ডলারের পন্য, যার মধ্যে ছিল প্লাস্টিক সামগ্রী, বেভারেজ স্পিরিট, ভিনেগার, মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি ও কিছু ইলেকট্রিক সরঞ্জামাদি। এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত এম ফজলুল করিম জানান, বাংলাদেশ মেইড মেডিসিন ও সিরামিক বাজারজাতকরণের উজ্জল সম্ভাবনা রয়েছে এখানে এবং এলক্ষ্যে ইতিমধ্যে তিনি দেশটির চেম্বার অব কমার্স সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ লেবেলে বিশেষ গ্রাউন্ডওয়ার্ক করে যাচ্ছেন।
রাষ্ট্রদূত আরো জানান, ‘‘সারা বিশ্বের কাছে মেক্সিকোর গুরুত্ব বিশেষ করে গত ১ দশকে বহুগণ বেড়ে গিয়েছে। গোল্ড, সিলভার, পেট্রোল ও গ্যাস সমৃদ্ধ এই দেশটি তাদের এক্সপোর্টের শতকরা ৮০ ভাগই করে থাকে প্রতিবেশি যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার কাছে। বাংলাদেশ দূতাবাস প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আমরা ব্যাপক প্রচারণার করে এবং উচ্চপর্যায়ে নিয়মিত মিটিং-লবিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে উৎসাহব্যাঞ্জক ধারণা দিয়ে যাচ্ছি, তুলে ধরছি আমাদের পজিটিভ ইমেজ।’’
রাষ্ট্রপতি এনরিক পেনা নিয়েতোর কাছে পরিচয়পত্র পেশকালে রাষ্ট্রদূত এম ফজলুল করিম তাঁকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। সুবিধাজনক সময়ে ঢাকায় রাষ্ট্রীয় সফরের আগ্রহ প্রকাশ করেন মেক্সিকান প্রেসিডেন্ট। তবে অচিরেই দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর নিশ্চিত করতে জোরেশোরে কাজ করছে বাংলাদেশ দূতাবাস। মেক্সিকোতে বাংলাদেশি স্কিল্ড আইটি প্রফেশনালদের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা থাকায় এলক্ষ্যেও কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানান রাষ্ট্রদূত।
মেক্সিকোর অন্যান্য সেক্টরে বাংলাদেশ থেকে বৈধ জনশক্তির সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম, কারণ দেশটিতে একদিকে যেমন আছে নিজস্ব বেকারত্ব, পাশাপাশি প্রতিবেশি দেশ গুয়েতেমালা, হন্ডুরাস ও এল সালভাদর থেকে লোকজন ভিন্নপথে আসা-যাওয়ার মাধ্যমে মেক্সিকো জুড়ে কাজ করে থাকে। তবে কৃষিক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুনাম থাকায় আগামীতে এই সেক্টরে বাংলাদেশ থেকে বৈধ জনশক্তির সম্ভাবনাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখছে মেক্সিকোর বাংলাদেশ দূতাবাস।
সেমিনার-সিম্পোজিয়াম আয়োজনে মেক্সিকোর খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল চলতি বছরের এপ্রিলে মেক্সিকো সিটিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সম্মেলনে যোগ দেয়। মে মাসে দেশটি সফরে আসেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রান মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। এছাড়া জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে হুইপ ইকবালুর রহিমের নেতৃত্বে সাবের হোসেন চৌধুরি সহ ৩ সদস্যের সংসদীয় প্রতিনিধি দল মেক্সিকো সফর করে।
এপ্রিলে অর্থমন্ত্রীর সফর দ্বিপাক্ষিক না হওয়া সত্বেও রাষ্ট্রদূত এম ফজলুল করিমের বিশেষ প্রচেষ্টায় মেক্সিকান পররাষ্ট্রন্ত্রীর সাথে একান্ত বৈঠক হয় আবুল মাল আবদুল মুহিতের। দ্বিপাক্ষিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো জোরদার এবং ব্যবসা-বানিজ্যের ব্যাপক প্রসারের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মেক্সিকোর সাথে বাংলাদেশ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাবে, এই আশাবাদ মেক্সিকো সিটিতে দায়িত্বরত বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতের। [/sociallocker]