তানিয়া হোসেন:
‘আর ইউ A ভার্জিন?’ এ প্রশ্নের সম্মুখীন দেশ-বিদেশে অবিবাহিত আমাকে বহুবার হতে হয়েছে। শুদ্ধ বাংলায় যদি এ প্রশ্নের অনুবাদ করা হয় তবে তা দাঁড়ায় ‘আপনার যোনি কি অক্ষত?’ ‘ভার্জিন’ অথবা ‘অক্ষত যোনি’–এই শব্দের গুরুত্ব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখনো বিদ্যমান। বাংলাদেশসহ অসংখ্য মুসলিম বিশ্বে এ শব্দের গুরুত্ব অন্যান্য দেশের চেয়ে অপেক্ষাকৃতভাবে একটু বেশি। মুসলিম বিশ্ব ব্যতীত অন্যান্য বিশ্বের পুরুষেরা মৌখিকভাবে যদিও বলে থাকেন যে তাদের কাছে এ শব্দের গুরুত্ব তেমন নেই তবে মনের ভেতর অনেকেই ভিন্নমত প্রদর্শন করে থাকেন। আবার উন্নত ও অনুন্নত বিশ্বের মাঝেও রয়েছে এ শব্দের গুরুত্বের ব্যবধান। যদিও পুরুষশাসিত এ সমাজে পুরুষরা ‘অক্ষত যোনি’ বা ভার্জিন নারী খোঁজেন আবার তারাই অন্যের ‘অক্ষত যোনি’কে যে কোনো মুহূর্তে ক্ষত করতে সদা প্রস্তুত থাকেন। কোনো কিছুকে একবার ক্ষত করে আবার কীভাবে তাকে অক্ষতভাবে পাওয়ার আশা করা যায় এটা আমার চিন্তায় আনতে বেশ কষ্ট হয়। বসে আছি তুরস্কের সবচেয়ে বড় শহর ইস্তাম্বুলের একটি কফিশপে। সামনেই বসে আছেন সদ্য পরিচিত বন্ধু আহমেদ কালিলি। মাত্র এক ঘণ্টা পূর্বে আমি নারিতা থেকে ইস্তাম্বুলে পৌঁছেছি। এখনো এয়ারপোর্ট থেকে বের হইনি। আমাকে নিতে আসবে আমার জাপান জীবনের বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী মোনা।
ওর কথায় পরে আসছি। তার আগে আমি আহমেদ কালিলির কথা একটু বর্ণনা করে নেই । আমি যখন ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টে পৌঁছাই তখন বাজে বেলা ছ’টা । লম্বা জার্নিতে বেশ ক্লান্ত আর মোনাও কাজ শেষ করে রাত ৮টার আগে নিতে আসতে পারেব না তাই ভাবলাম একটু এয়ারপোর্টের ভেতরের কফিশপে বসে কফি খাই। কফিশপ ভর্তি মানুষ তবে আমার মতো একা কোনো মেয়ে চোখে সে সময় পড়েনি। কফিশপে প্রবেশ করে প্রথমে আমার যা মনে হলো তা হচ্ছে তুরস্কের ছেলেরা দেখতে খুব হ্যান্ডসাম। একা একা বসে কফি খাচ্ছি আর এদিক-সেদিক তাকাচ্ছি আর আমার সামনের সিটটি ফাঁকা। হঠাৎ একজন সুদর্শন পুরুষ আমার সামনে এসে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করে, ‘আমি কি এখানে একটু বসতে পারি?’ আমি জবাবে বললাম, ‘অবশ্যই’। ভদ্রলোক বসলেন এবং স্বাভাবিকভাবেই শুরু হলো কথোপকথন। শুভেচ্ছা বিনিময় থেকে শুরু করে অনেক কথাই হলো এবং এক পর্যায়ে ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি একা ঘুরতে এসেছেন? আমি গভীর আগ্রহে উত্তর দিলাম, জি! আমি সমগ্র বিশ্ব একা ভ্রমণ করি। এ কথা শোনার পর তার ভ্রু একটু কুঁচকে উঠল এবং কথোপকথনের ধরনটাও একটু পাল্টে গেল। তার কথার মাঝে যে টোনটা পেলাম তা হচ্ছে আমার বোধহয় সমগ্র বিশ্বের সব দেশেই একজন করে পুরুষমিত্র আছে এবং আমি যেখানে-সেখানে যখন-তখন বস্ত্র উন্মোচনে প্রস্তুত। অনেকটা নাবিকের বন্দরে বন্দরে বউয়ের মতো। সবশেষে উনি নিজেকে সংযত করতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেই বসলেন, ‘আপনি কি ভার্জিন?’ আমি ভদ্রলোকের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভদ্রভাবে প্রসঙ্গ পাল্টাই। এতে রাগ হয়ে অথবা চিৎকার করে কোনো লাভ নেই কারণ এটা শুধু আহমেদ কালিলি না, তার মতো অনেক পুরুষই আমাকে দেখে ভেবে থাকেন।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীদের স্বাধীনভাবে চলাফেরাটা এখনো খুব একটা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হয় না। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ পাল্টাচ্ছে এবং সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মানসিকতাও। তবুও কেন জানি একা মেয়ের বিশ্ব ভ্রমণ অনেকেই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেন না এবং অপ্রত্যাশিত ও অশালীন প্রশ্ন করেন। আমি একজন প্রফেশনাল নারী। আমি শিক্ষকতার পাশাপাশি দোভাষীর কাজ করি। কনফারেন্সে পেপার পড়া ছাড়াও দোভাষীর কাজে আমাকে বিদেশে যেতে হয়। এ ছাড়াও বিশ্রামের প্রয়োজনেও অবসর যাপনের জন্যও বিদেশ যেতে হয়।
এর অর্থ এই না যে বিভিন্ন পুরুষের সঙ্গে মেলামেশাই একমাত্র লক্ষ্য। বুঝতে পারি অনেক পুরুষই তাদের ব্যক্তিগত ‘অভিজ্ঞতা’ থেকেই এ প্রশ্ন করেন; তবুও এ ধরনের প্রশ্ন একজন নারীর কাজের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা অথবা নারীর প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করাই হয়ে থাকে। এতে নারী বাইরে কাজে যাওয়ার প্রতি অনুৎসাহিত হয়। এ ধরনের অসম্মানজনক প্রশ্ন থেকে নিজেকে বিরত রাখলে নারী দেশ ও সমাজের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত বোধ করেন, আর পরপুরুষের সঙ্গে বিছানা যাপনের জন্য বন্দরে বন্দরে তরী ভেরাবার প্রয়োজন হয় না, নিজের ঘরই যথেষ্ট। নিজেদেরকে জাগ্রত করতে না পারলে সমাজে ভোর আসে না। ভোর আনার দায়িত্ব আমাদের এ বিশ্বের সবারই। কথা বলতে বলতে ৮টা বেজে গেল এবং আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী মোনা আমাকে ফোন করল। জানতে পারলাম যে মোনার সেদিন রেডিও প্রোগ্রাম আছে বলেই সে আসতে পারবে না। মোনা তার ড্রাইভারকে পাঠাল।
এবারের ফ্লাইটটি একটু ভিন্ন ধাঁচের ছিল। ফ্লাইটে বসে আমি আমার উপন্যাস লিখছিলাম। ছোট বাতি জ্বালিয়ে লিখছিলাম বলেই হয়তো মাথায় অসম্ভব রকমের ব্যথা ধরে যায়। আমি ভুল করে প্যানাডোলরে পরিবর্তে ফ্লাজিল নিয়ে ভ্রমণ শুরু করি। যখনই আমি আমার ফার্স্ট এইড বক্স খুলি ঠিক তখনই দেখি যে প্যানাডোল নেই। সাধারণত ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টের কাছে চাইলে প্যারাসিটামল দেয়। কিন্তু তুর্কি এয়ারলাইন্সে এ ব্যবস্থা নেই। এবার যাচ্ছি সরাসরি নারিতা থেকে তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে, ১২ ঘণ্টার দীর্ঘ ফ্লাইট। পথে কোনো বিরতি নেই। ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টের কাছে প্যানাডোল ট্যাবলেট চাইলে তারা আমাকে জানায় যে তুর্কি এয়ারলাইন্সে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ দেয়া হয় না কারণ এর আগে ওষুধ দিয়ে বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে। এবার আমি যাচ্ছি বিজনেস ক্লাসে। যদিও ইকোনমি ক্লাসে আমি টিকেট কাটি কিন্তু
যেদিন বিজনেস ক্লাস খালি থাকার কারণে দুশ ইউরো বেশি দিয়ে আমি বিজনেস ক্লাসে বসি। মাইকে ডাক্তার ডাকা হয়। ফার্স্ট ক্লাস থেকে ডাক্তার আসেন এবং আমার নাড়ি পরীক্ষা করে বলেন যে, আমাকে পেইনকিলার দেয়া যায়, পেছন থেকে এক অস্ট্রেলিয়ান দম্পতি এক প্যাকেট প্যানাডোল আমাকে এগিয়ে দেন এবং ডাক্তার সাহেব হাসতে হাসতে চলে যান। ফ্লাইট ল্যান্ড করলে একটু কফি খেয়ে ফ্রেশ হব বলে কফিশপে বসি আর তখনই এই আহমেদ কালিলির সঙ্গে দেখা হয়।
রাত সাড়ে ৮টার সময় আমার কাছে আবারো ফোন এলো। এবারের ফোন এলো সাহিল নামের একজন তুর্কি ভদ্রলোকের কাছ থেকে। সাহিল আমাকে জানাল যে সে মোনার ড্রাইভার এবং আমাকে নিতে এয়ারপোর্টে এসেছে। আমি সাহিলকে খুঁজে বের করে রওনা হয়ে যাই হোটেলের উদ্দ্যেশে । হোটেলও মোনা ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। মোনার বাড়ি থেকে হেঁটে ৫ মিনিটের পথ। সেদিন পথে ছিল প্রচন্ড জ্যাম, দেড় ঘণ্টা গাড়ি চলার পর গাড়ি এসে থামল হোটেলের সামনে। বেশ বড় ও অত্যাধুনিক হোটেল। কামরা বেশ পছন্দ হলো আমার। চেঞ্জ করে চলে এলাম মোনার বাড়িতে।
মোনার বাড়িতে পৌঁছাতেই দেখি যে মোনা তাড়াহুড়ো করে কাজ সেরে আমার জন্য রাতের খাবার তৈরি করে রেখেছে। বিশাল আয়োজন। বাড়িতে ছিল মোনার স্বামী, ৪ বছরের সন্তান ও মিসরীয় আরবির শিক্ষক। মোনার স্বামী আমি প্রফেসর শুনে আমাকে বাড়ির সবচেয়ে ভালো চেয়ারে বসতে দেন এবং পরবর্তী তিনদিনের জন্য আমাকে একটি গাড়ি ও ড্রাইভার দিয়ে দেন। যদিও আমি তাদের বাড়িতে প্রফেসর হিসেবে যাইনি তবুও উনি আমাকে যে সম্মান প্রদর্শন করেন তা ভুলে যাওয়ার মতো নয়। ভদ্রলোক একজন চিকিৎসক এবং আমার বুঝতে বাকি থাকল না যে কেন উনি এত বড় হয়েছেন? অন্যকে সম্মান প্রদর্শন করেন বলেই সমাজে ওনার এত ওপরে অবস্থান। আমাদের দেশে এর ঠিক উল্টোটা দেখা যায়। আমরা সম্মানিত মানুষের অসম্মান প্রদর্শনের মাঝেই নিজেদের সম্মান খুঁজে পাই। এর পরিবর্তন না হলে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। মোনার বাড়িতে রাতের খাবার সেরে অনেকক্ষণ আড্ডা দিয়ে পুরনো দিনের স্মৃতি উন্মোচন করে হোটেলে ফিরে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ি। কারণ পরের দিন সকালে আমাকে বোয়াজইচি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে, সকাল ৯টায় আমার প্রেজেন্টেশন।
[[ আপনি জানেন কি? আমাদের সাইটে আপনিও পারবেন আপনার নিজের লেখা জমা দেওয়ার মাধ্যমে আপনার বা আপনার এলাকার খবর তুলে ধরতে জানতে “এখানে ক্লিক করুণ” তুলে ধরুন নিজে জানুন এবং অন্যকে জানান। ]]