মাঈনুল ইসলাম নাসিম : গুলশান অ্যাটাকের পর কমান্ডো অভিযানের সাফল্য তুলে ধরে করে জাতির উদ্দেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি যে ভাষণ দিয়েছেন, তার বিশেষ কিছু অংশ মনঃপুত হয়নি ইতালীর বিভিন্ন শহরে স্থানীয় ইতালীয়ান নাগরিকদের কাছে। শোকে মুহ্যমান গোটা ইতালীতে সবার দৃষ্টি যথারীতি এখনো বাংলাদেশের দিকে। সংবাদ মাধ্যমের কল্যানে ঢাকার প্রতিটি সংবাদ সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হচ্ছে এখানকার বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে। আপনার দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী কমান্ডো অভিযান যদি সফলই হবে, তবে ৯ জন ইতালীয়ান নাগরিককে কেন যথাসময়ে জীবিত উদ্ধার করা যায়নি সেই প্রশ্ন অনেকেই আপনাকে করছেন সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। ব্যবসা-বানিজ্য-বিনিয়োগের জন্য গিয়ে স্বদেশীদের ফিরতে হচ্ছে আজ লাশ হয়ে, এই যন্ত্রণায় বাংলাদেশকে দারুন ‘অনিরাপদ’ মনে করছেন আজ ইতালীয়ানরা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জাতির উদ্দেশে দেয়া বক্তব্য নিজে ড্রাফট করার সব ধরনের যোগ্যতা আপনার আছে, এটা আমরা খুব ভালো করে জানি। লাল-গোলাপ হাতে নিয়ে কেউ আপনার বক্তব্য লিখে দিতে হয় না, এটিও আমাদের অজানা নয়। তারপরও আপনার উপদেষ্টারা আছেন, বিশেষ সহযোগীরা আছেন। যদি তাই হবে, তবে কেন সঠিক চিত্রটি শুদ্ধভাবে তুলে ধরা হয়নি আপনার বক্তব্যে ? সেনা-বিমান-নৌ কমান্ডোরা ১৩ জন জিম্মিকে ‘অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার’ করেছে, শোকের এই সময়টাতে এই তথ্যটি শতভাগ মিথ্যা ও বানোয়াট ঠেকেছে ইতালী সহ গোটা গ্লোবে। ‘ওপেন সিক্রেট’ সত্য হচ্ছে, ধর্মীয় মুখোশধারী টেরোরিস্টরা অপ্রয়োজনীয় লোকদের ‘জানে মারেনি’ তাদের পূর্বনির্ধারিত মাস্টার প্লান অনুসারেই। টেরোরিস্টরা অবশ্যই জানতো এই অভিযান সফল বা ব্যর্থ যাই হোক না কেন, তারা পালাতে পারবে না। এমনকি সুসজ্জিত বিভিন্ন বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয়ী হবার কোন পরিকল্পনাও নিশ্চয়ই তাদের ছিলো না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মিশন ‘শতভাগ সাক্সেসফুল’ করার পর বীরদর্পে ফ্রিস্টাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করে নিহতের সঠিক সংখ্যা ও জেনুইন ছবি বাইরে পাঠিয়ে জঙ্গীরা বরং খুব স্মার্টলি অপেক্ষায় ছিলো স্বাভাবিক পরিণতি তথা নিশ্চিত মৃত্যুর। এখানে আমাদের সেনা-বিমান-নৌ কমান্ডোরা বা যে কোন এজেন্সি বা ফোর্স তাদের পেশাগত দায়িত্বটিই শুধু পালন করেছে শনিবার ভোরে। টেরোরিজম টার্গেট আগেই ফুলফিল হওয়ায় টোটাল ক্রেডিট অবশ্যই গোউস টু টেরোরিস্টস এখানটায়। কমান্ডো অভিযানকে ‘সফল’ বলে কোন ধরনের মানসিক শান্তনার এই মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন নেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ! তাছাড়া আপনার এই ধরনের বক্তব্য ভিক্টিম ৯টি ইতালীয় পরিবার সহ সাড়ে ৫ কোটি ইতালীয়ানদের কাছে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো ঠেকেছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি তো জানেন, প্রায় ২ লাখ বাংলাদেশীর বসবাস ইতালীতে। জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষনের আগে আপনার জন্য বেশি জরুরী ছিলো ইতালীর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাত্তেও রেনজিকে একটি ফোন দেয়া। তিনি তো আপনাকে খুব ভালো জানেন, কয়েকবার আপনাদের দেখাও হয়েছে ইতালী সহ বিশ্বের নানা প্রান্তে। সাদা-লাল-সবুজের জাতীয় পতাকাবাহী ইতালীয় বিশেষ বিমান ঢাকার পথে আকাশে ওড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, জাতীয় বীরদের মরদেহ বহন করে ভূমধ্যসাগর তীরে রোমে নিয়ে আসার জন্য। শোকের সাগরে ভাসছে আজ গোটা ইতালী। মেক্সিকো সফর সংক্ষিপ্ত করে রোমে ফিরে আসছেন ইতালীর মহামান্য রাষ্ট্রপতি সের্জো মাতারেল্লা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাত্তেও রেনজির চোখেও জল। মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় শোকের সব আনুষ্ঠানিকতা এখানে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দক্ষিণের সিসিলি দ্বীপ থেকে শুরু করে উত্তরে আল্পস পর্বতমালা সাড়ে ৫ কোটি ইতালীয়ানরা চরম ক্ষুব্ধ ঢাকা ট্র্যাজেডির ভয়াবহতায়। বাংলাদেশ-ইতালী রপ্তানী বানিজ্যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ার শংকা বিভিন্ন মহলে। আইএস-এর সুনিশ্চিত নতুন গন্তব্য এখন বাংলাদেশ, জোরেশোরে চলছে ইতালীয়ান ময়নাতদন্ত। আমরা হতবাক হচ্ছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, কেন আপনার উপদেষ্টা ও বিশেষ সহযোগীরা ইতালীয় সরকার প্রধানকে আপনার ‘অতি আবশ্যক’ ফোনটি দেয়ার সুবন্দোবস্ত করছেন না ? গত ২০ বছর এই দেশটিতে আমার টানা প্রবাস জীবনে আপনাকে বহুবার দেখেছি রাষ্ট্রীয় সফর করতে। ইতালীয় জনগনেরও আতিথেয়তা আপনি পেয়েছেন আমাদের চোখের সামনেই। আর দেরি নয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ! বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরো ধ্বস নামার আগেই ইতালীয় প্রধানমন্ত্রীকে আজ-কালের মধ্যেই জরুরী ভিত্তিতে ফোন দিয়ে সর্বোচ্চ শান্তনা ও সমবেদনা পৌঁছে দিন নিহত ৯টি পরিবার সহ গোটা দেশ ও জাতির কাছে।
২ লাখ বাংলাদেশীর বসবাস ইতালীতে,তাদের কথা চিন্তা করে ভাল কোন পদক্ষেপ নিন