পেশাদার কূটনীতিক মাহফুজুর রহমানের সাথে এই প্রতিবেদকের একান্ত আলাপচারিতায় উঠে আসে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের জোয়ার-ভাটা এবং চলমান বাস্তবতার সর্বশেষ আপডেট। রাষ্ট্রদূত জানান, “এটা সত্য যে, বাংলাদেশের সঙ্গে পোল্যান্ডের সম্পর্ক ঐতিহাসিক এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয় তথা আমাদের স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধ সবকিছুর সঙ্গেই পোল্যান্ড জড়িত ছিল। সুতরাং পোল্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্কটা তৈরী হয়েছিল বাংলাদেশের শুরু থেকেই । কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, ১৯৯০-৯১’র পরে যখন কমিউনিস্ট এবং সোভিয়েত বলয়ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বড় ধরনের একটা রাজনৈতিক পরিবর্তন আসে, সেই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের সঙ্গে পোল্যান্ডের সম্পর্কের আগে যে উষ্ণতা বা নৈকট্য ছিলো, সেখানে কিছুটা ভাটা পড়ে”।
রাষ্ট্রদূত মাহফুজুর রহমান আরো বলেন, “এখন পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে পোল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের যে মাত্রা, সেগুলো ভিন্ন রকম। আগের ঐতিহাসিক সেই মাত্রা বা সেটার গুরুত্ব এখানে অনেক কমে গেছে এখন। আন্তর্জাতিক বানিজ্যের কারণে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এবং বিভিন্ন বৈশ্বিক ইস্যুতে সম্পর্ক উন্নয়নের স্বার্থে আমাদের দুই দেশের মধ্যে এখন সম্পর্ক রচিত হচ্ছে তাই নতুন করে নতুন মাত্রায়। কিন্তু আগের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটা এখানে অনেকখানি হারিয়ে গেছে। দুঃখজনকভাবে ২০০২ সালে ওয়ারশতে আমরা আমাদের দূতাবাস বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তার ৩ বছর পর ২০০৫ সালে পোল্যান্ডও বন্ধ করে দেয় ঢাকায় তাদের দূতাবাস”।
ওয়ারশতে বাংলাদেশ দূতাবাস বন্ধের সিদ্ধান্ত কতটা ভুল ছিল জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত বলেন, “তখনকার প্রেক্ষাপট আমার কাছে পুরোপুরি স্পষ্ট নয়, কিন্তু আমি বলবো যে, সিদ্ধান্তটি হয়তো ঠিক ততোটা দূরদর্শী ছিলো না। কারণ আমরা এমন একটা সময় ওয়ারশতে বাংলাদেশ দূতাবাস বন্ধ করেছিলাম, যে সময়টাতে পোল্যান্ড ন্যাটো এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মেম্বার হচ্ছিল। সুতরাং তখন তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরো গভীর হওয়ার সুযোগ ছিল। সেটা আমরা মিস করেছি”। ১৪ বছর আগের প্রেক্ষাপট নিয়ে রাষ্ট্রদূত বিস্তারিত কিছু না বললেও রাজধানী ওয়ারশ’র বাংলাদেশ কমিউনিটি এজন্য দায়ী করে থাকে দূতাবাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময়ে দায়িত্বপালনকারী রাষ্ট্রদূত ড. এম এ সামাদের অপরিপক্কতা ও ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলকে। পরিণতিতে ২০০৫ সালে ঢাকা থেকেও সবকিছু গুটিয়ে চলে আসে পোলিশ দূতাবাস।
ঢাকায় পোলিশ পতাকা আবার কবে নাগাদ উড়বে, জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত মাহফুজুর রহমান বলেন, “এখানে আমরা নতুন করে দূতাবাস খোলার সঙ্গে সঙ্গে পোল্যান্ডের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, এখন এটা একটা স্বাভাবিক বিষয় যে, আমরাও বাংলাদেশে দূতাবাস খুলবো। কিন্তু এরই মধ্যে অর্থাৎ সাম্প্রতিককালে এদের সরকার পরিবর্তন হওয়ার কারণে আমি যতটুকু ধারনা করছি, অতো সহসা এরা ঢাকায় দূতাবাস খুলছে না। এদের পক্ষ থেকে সম্ভাবনাটিকে বাতিল করা না হলেও আমি বুঝতে পারি যে, এটা আগে যতোটা দ্রুততার সঙ্গে হতো, এখন ততোটা দ্রুততার সঙ্গে হবে না। তবে আমরা আশা ছাড়ছি না। অদূর ভবিষ্যতে পোলিশ দূতাবাস অবশ্যই একদিন আলোর মুখ দেখবে ঢাকায়। পোল্যান্ড তাদের অর্থনীতি যতো উন্নত করতে চাইবে, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে দূতাবাস খোলা তাই তাদের খুবই জরুরী”।
টানা ১৩ বছর ওয়ারশতে বাংলাদেশ দূতাবাস না থাকলেও আশার কথা হচ্ছে, পোল্যান্ড-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বানিজ্য গত অর্থবছরেও ছিল প্রায় বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। রাষ্ট্রদূত মাহফুজুর রহমান জানান, “দূতাবাস যেহেতু নতুন, তাই ঢাকা থেকে রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো আমাদেরকে এখনো ঠিক সেরকম কোন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়নি। তবে আমরা থেমে নেই, কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আগে থেকেই স্থাপিত একটা দূতাবাসের পক্ষে যে মাত্রায় কাজ করা সম্ভব হতো, দূতাবাস নতুন হওয়ার কারণে আমাদের পক্ষে এখনো সে মাত্রায় কাজ করা সম্ভব হয়নি। হয়তো আরো কিছু সময় লাগবে দূতাবাসকে পুরোপুরি সক্ষম করে তুলতে। অবশ্য গত ১ বছরে সক্ষমতা অনেক বেড়েছে এবং দ্বিপাক্ষিক বানিজ্য আরো বৃদ্ধির যথেষ্ট সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। যে কোন সময় এটা ক্লিক করে যেতে পারে এবং তখন দু’দেশের মধ্যে বানিজ্য অনেক বেড়ে যাওয়া দৃশ্যমান হবে”।