বাংলাদেশ সরকারের ই-সার্ভিস বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সাম্প্রতিককালে প্রশাসনের সকল স্তরে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট চালু করার নির্দেশ দেয়া হলেও এটিকে ন্যূনতম আমলে নেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস ও হাইকমিশন সমূহ। প্রশাসনযন্ত্রের সকল স্তরে বাধ্যতামূলকভাবে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলা সংক্রান্ত সরকারী নির্দেশের প্রেক্ষিতে দেশের সকল মন্ত্রনালয়, সব বিভাগীয় কমিশনার, সকল জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং প্রায় সব উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা (ইউএনও) ইতিমধ্যে তাদের স্ব স্ব অফিসের নামে ফেসবুক পেজ চালু করেছেন।
এসব অ্যাকাউন্ট তথা পেজের মাধ্যমে তারা দৈনন্দিন কার্যকলাপ ও সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচী সম্পর্কে জনসাধারনকে অবহিত করছেন। পাশাপাশি জেলা বা উপজেলার অধিবাসীদেরকে আরও বেশি কাছাকাছি নিয়ে আসছেন প্রশাসনের। উদাহরণ স্বরূপ ফেসবুকে যে কেউ বাংলায় (উপজেলা প্রশাসন, পঞ্চগড় সদর) লিখলেই দেখতে পাবেন পঞ্চগড়ের ইউএনও পর্যন্ত কিভাবে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন সরকারী নির্দেশ। অথচ সেগুনবাগিচার পররাষ্ট্র দফতর যেন বরাবরের মতো ফেসবুক ইস্যুতেও রয়ে গেছে সকল প্রকার জবাবদিহিতার উর্ধ্বে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের (MOFA) ওয়েবসাইটে প্রদত্ত তথ্য মোতাবেক প্রায় অর্ধশতাধিক দেশে বাংলাদেশের রয়েছে অন্ততঃ ৬৫টি দূতাবাস, মিশন, হাইকমিশন, ডেপুটি হাইকমিশন, কনস্যুলেট জেনারেল ও ভিসা অফিস। কিন্তু জায়ান্ট নেটওয়ার্ক ফেসবুকে তন্নতন্ন করে খুঁজে পাওয়া যায়নি ৩টির বেশি দূতাবাসের কার্যকর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বা পেজ, যা আপডেট হয় প্রতিনিয়ত। আরো ১১টি দূতাবাস বা মিশনের ফেসবুক পেজ থাকলেও তা একেবারেই দায়সারা গোছের। কোন কোনটিতে আপডেট হয় ছয় মাস নয় মাস পরপর আবার কিছু আছে যাচ্ছেতাই বেহাল অবস্থায়।
নিয়মিত পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, নেদারল্যান্ডস কুয়েত ও লিবিয়া এই তিনটি দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের ফেসবুক পেজের পারফরম্যান্স দারুন আশাব্যাঞ্জক। বিশেষ করে বাংলাদেশ দূতাবাস নেদারল্যান্ডসের ফেসবুক স্ট্র্যাটেজি এবং আপডেট এক্টিভিটি অন্য যে কোন বাংলাদেশ দূতাবাসের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে নিঃসন্দেহে। দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক বানিজ্যিক সাংস্কৃতিক তথা অগ্রসরমান কূটনৈতিক সম্পর্কের নানান বিষয়াদি ছাড়াও ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্যাদির সন্নিবেশনে বাংলাদেশ দূতাবাস নেদারল্যান্ডসের সমৃদ্ধ ফেসবুক পেজের (Embassy of Bangladesh, The Hague, Netherlands) জনপ্রিয়তা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দায়সারা গোছের ফেসবুক পেজের তালিকায় রয়েছে জার্মানী, ইতালি, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, উজবেকিস্তান, দক্ষিণ কোরিয়া, নেপাল ও মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস বা হাইকমিশন। একই দশা দুবাইতে বাংলাদেশ কস্যুলেট অফিসেরও। নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের ফেসবুক পেজটির বেহাল দশা রীতিমতো চোখে পড়ার মতো। Bangladesh Permanent Mission to the United Nations, New York লিখে জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের অফিসিয়াল পেজটির চিত্র দেখে বিব্রত হবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত ৬৮ তম ইউএন অধিবেশনের এক হালি ফটো আপলোড দিয়েই যেন খালাস।
গত বছরের ৪টি আলোকচিত্র, তাও আবার আপলোড করা হয় এ বছর মে মাসে। এরপর আর ঘুম ভাঙ্গেনি এই পেজের এডমিনের। এমনকি অতি সাম্প্রতিককালে নিউইয়র্কে ৬৯তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর যোগদানের কোন আপডেট দেয়ার প্রয়োজন মনে করা হয়নি পারমানেন্ট মিশনের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ দূতাবাস সমূহের ফেসবুক বিমুখতা এখানেই শেষ নয়। মধ্যপ্রাচ্যের যে দেশটি থেকে সবচাইতে বেশি রেমিটেন্স বাংলাদেশের, ৩০ লাখ বাংলাদেশি অধ্যুষিত সৌদি আরবস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের আদৌ কোন ফেসবুক পেজ বলতে কিছু নেই।
সার্চ করে Bangladesh Embassy in Jeddah, Saudi Arabia নামে একটি পেজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেলেও নামেও যেমন ভুল তেমনি আপডেট বিহীন এই একাউন্টটিকে ফেক বা ভূয়া হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। কারণ সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস রয়েছে রাজধানী রিয়াদে এবং জেদ্দায় কনস্যুলেট জেনারেল। লন্ডন ওয়াশিংটনের মতো কানাডার অটোয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন, টোকিওতে বাংলাদেশ দূতাবাস, ব্রাসেলসে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে বাংলাদেশ দূতাবাস এমনকি সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে বাংলাদেশ পারমানেন্ট মিশনেরও অস্তিত্ব নেই ফেসবুকে।
সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী এখন বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি লোক যেমন ফেসবুক ব্যবহার করছে, পাশাপাশি বিশ্বের দেড় শতাধিক দেশে বসবাসরত প্রায় এক কোটি প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রায় অধিকাংশই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কম-বেশ সম্পৃক্ত রয়েছেন সামাজিক যোগাযোগের এই জনপ্রিয় মাধ্যমের সাথে। ৬টি মহাদেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে অভিমত দিয়েছেন, নেদারল্যান্ডস কুয়েত ও লিবিয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের ফেসবুক পেজের এক্টিভিটিকে নমুনা হিসেবে সামনে রেখে বিশ্বব্যাপী প্রতিটি দূতাবাস, মিশন, হাইকমিশন, ডেপুটি হাইকমিশন, কনস্যুলেট জেনারেলকে ফেসবুক জগতে সচল করার এখনই সময়।
প্রবাসীদের মতামত, অন্য দেশগুলো পারলে বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে থাকবে ? সবার সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশকেও। বিদেশে প্রতিটি বাংলাদেশ মিশনের নিজস্ব ফেসবুক পেজ সচল ও সক্রিয় হলে একদিকে যেমন সংশ্লিষ্ট দেশের সাথে ট্রেড এন্ড কমার্সে নতুন গতি সঞ্চার হবে, তেমনি রেমিটেন্সের উৎস লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও রকমারী প্রয়োজন পূরণের পাশাপাশি বহুবিধ সমস্যার সমাধান সহজ থেকে সহজতর হবে। বিভিন্ন কার্যকলাপ ও কর্মসূচীর নিয়মিত আপডেট থাকলে দূতাবাস, মিশন, হাইকমিশন, ডেপুটি হাইকমিশন, কনস্যুলেট জেনারেল একাধারে তাদের জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করতে পারবে সোশ্যাল এই নেটওয়ার্কের সহযোগিতায়।
প্রয়োজনের নিরিখে একটি নতুন ইউনিটও চালু করা যেতে পারে এক্ষেত্রে ঢাকার পররাষ্ট্র দফতরে, যাদের কাজ হবে প্রতিটি বাংলাদেশ মিশনের ফেসবুক পেজ মনিটরিং এন্ড কোঅর্ডিনেশন। বাংলাদেশ মিশন সমূহকে ফেসবুক বান্ধব করতে প্রবাসীদের অনেকেই বিশেষ সুদৃষ্টি কামনা করেছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি’র, যাঁর ফেসবুক পেজ ইতিমধ্যে ফেসবুক অথরিটি কর্তৃক ‘ভেরিফায়েড’ হবার গৌরব অর্জন করেছে। সরকারের ‘ইকোনমিক ডিপ্লোমেসি’ পলিসিকে সফল করতে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণে ফেসবুক হতে পারে অন্যতম সহায়ক। যুগপত এগিয়ে যেতে পারে ‘ব্র্যান্ডিং বাংলাদেশ’ দেশ থেকে দেশান্তরে।