মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) ইস্যুতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সাথে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের অপ্রীতিকর টানাপোড়নের নেপথ্যনায়ক তিনি। বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যান মন্ত্রনালয়ের সাথেও পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সমন্বয়হীনতা কমার পরিবর্তে দিনকে দিন বাড়ার পেছনে সর্বাগ্রে দায়ী ‘বারুদের বেগে’ প্রমোশন পাওয়া সচিব শহীদুল হকের চরম স্বেচ্ছাচারিতা। সুবিধাবাদী এই কর্মকর্তার ‘খুঁটির জোর’ থাকায় তাকে নিয়ে ‘বুক ফাটেতো মুখ ফুটে না’ অবস্থা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সিনিয়র কূটনীতিকের। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা এই প্রতিবেদককে বলেছেন, “সচিব শহীদুল হক এক কথায় মন্ত্রনালয়ের বোঝা, অনভিজ্ঞতার কারণে যিনি কাজের চাইতে নিজের সিন্ডিকেট রক্ষা করা এবং আখের গোছাতেই এখন বেশি ব্যস্ত”।
২০১২ সালের শেষদিকে যখন তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েসকে লন্ডনে হাইকমিশনার নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছিল, তখন নয়া পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে যে দু’-তিনজনের নাম সামনে চলে আসে যোগ্যতার ভিত্তিতে, তাদের মধ্যে ছিলেন দুই সিনিয়র কূটনীতিক জেনেভায় বাংলাদেশ মিশনের প্রধান রাষ্ট্রদূত আবদুল হান্নান এবং ব্রাসেলসে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ইসমত জাহান। কিন্তু যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাকে ‘বুড়ো আঙ্গুল’ দেখাবার মধ্য দিয়ে হঠাৎ লাইমলাইটে চলে আসেন সুদীর্ঘ ১১ বছর ছুটিতে (লিয়েন) থাকা শহীদুল হক।
২০০১ থেকে ২০১২ সুইজারল্যান্ডের জেনেভা ভিত্তিক আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর বিভিন্ন বৈদেশিক শাখায় কাজ করেন তিনি। তার আগে ১৯৯৯ থেকে ২০০১ এই সময়টাতে জেনেভাস্থ বাংলাদেশ মিশনে কাউন্সিলর থাকাকালীন সেখানে অবস্থিত আইওএম সদর দফতরে যাওয়া-আসার সুবাদে নতুন চাকরি নিশ্চিত করেন শহীদুল হক। ১১ বছর পর দেশে ফিরে পররাষ্ট্র সচিব বনে যাবার নেপথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যান এবং সমাজকল্যান বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী সহ আরো বেশ ক’জন ব্যক্তির কৃপায় শহীদুল হক জেনেভাস্থ আইওএম অফিস থেকে ঢাকায় এসে যোগ দেন পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে।
পররাষ্ট্র সচিব হবার মতো স্বভাবিক ও যথাযথ যোগ্যতাবিহীন শহীদুল হককে তখন হু-হু করে দেয়া হয় প্রমোশন। অতীতে কখনো কোন ইউনিটের ডিজি’র দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রথমে তাকে অল্প ক’দিনের জন্য একটি ইউনিটের ডিজি করে পুরোপুরি অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্রথমে এডিশনাল সেক্রেটারি এবং আরো দ্রুততম সময়ের ব্যবধানে ফুল সেক্রেটারি তথা একেবারে পররাষ্ট্র সচিবের পদে বসিয়ে দেয়া হয়। গত বছর জানুয়ারিতে শহীদুল হকের এই অনৈতিক ও অস্বাভাবিক নিয়োগে ক্ষুব্ধ হন সিনিয়র কূটনীতিকরা। কার কানে কে দেয় পানি, সচিব পদে থেকে যান এবং এখনো আছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে এযাবতকালের সবচাইতে অনভিজ্ঞ এই অফিসার।
প্রায় পৌনে দু’বছর অতিবাহিত হলেও পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে শহীদুল হকের ‘এচিভমেন্ট’ বলতে কখনো কিছু ছিল না, এখনো তা রীতিমতো শূন্যের কোঠায়। মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর মতো অভিজ্ঞ সিনিয়র কূটনীতিক এবং প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের মতো ‘ডায়নামিক এন্ড অ্যাকটিভ’ ব্যক্তিরা যেখানে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন সরকারের ‘ইকোনমিক ডিপ্লোমেসি’তে বাড়তি ‘ডায়নামিজম’ আনয়ণে, সেখানে সচিব শহীদুল হকের আনাড়িপনা ও স্বেচ্ছাচারিতা দিনকে দিন এখন সীমাহীন হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশিদেরকে স্বল্পতম সমময়ের মধ্যে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) হাতে পাওয়া সুনিশ্চিত করতে বৈদেশিক বিভিন্ন মিশনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের উইং খোলার প্রক্রিয়ায় বাধ সাধেন সচিব শহীদুল হক।
“আর্থিক বিষয়ের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত কনস্যুলার সেকশনের কর্তৃত্ব অন্যের হাতে দেয়া যাবে না”- অধঃস্তন কর্মকর্তাদের মগজে এমনটা ঢুকিয়ে দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে একটি বিশেষ সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এখন সচিব শহীদুল হক। তার প্রতিজ্ঞা ছিল যে কোন মূল্যে ঠেকিয়ে দেবেন দূতাবাসগুলোতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের উইং খোলার প্রক্রিয়া। পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের প্রচলিত রীতিনীতি ও মৌলিক চেতনার দোহাই দিয়ে এবং ‘রুলস অব বিজনেস’ ও ‘এলোকেশন অব বিজনেস’-এর মূলা ঝুলিয়ে সচিব শহীদুল হক অযৌক্তিক চিঠি ইস্যু করার পাশাপাশি বারবার বাধা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের স্বাভাবিক কাজে।
সুবিধাবাদী এই সচিবের এযাত্রায় দুর্ভাগ্য এবং ‘রেমিটেন্সের উৎস’ প্রবাসীদের জন্য সৌভাগ্য যে, তার নেক্কারজনক বিরোধিতা সত্বেও সরকার আটটি দেশের ১০টি বাংলাদেশ মিশনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের উইং স্থাপনের প্রস্তাব অনুমোদন করে। এর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরবের জেদ্দা ও রিয়াদ, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই ও আবুধাবি, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর, ওমানের মাস্কাট, কাতারের দোহা, কুয়েতের কুয়েত সিটি, সিঙ্গাপুরের সিঙ্গাপুর সিটি এবং ইতালির রোমে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশন।
উপরোক্ত মিশন সমূহে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের আলাদা উইং স্থাপন সংক্রান্ত সরকারী আদেশ (জিও) জারি হলেও পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক ও তার সিন্ডিকেট সরকারী আদেশের বিরুদ্ধেই এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের দ্রুত এমআরপি ও এমআরভি প্রদানসহ কনস্যুলার সেবা বাড়াতে ২০ সেপ্টেম্বর শনিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে সিনিয়র সচিব ড. মোজাম্মেল হক খানের সভাপতিত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপস্থিত থাকার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের একজন কর্মকর্তাকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও ‘শহীদুল হক সিন্ডিকেট’-এর অর্ধডজন কর্মকর্তা কোমর বেঁধে হাজির হন সেখানে, বিরোধিতা করেন তারা সরকার কর্তৃক অনুমোদিত উইং স্থাপনের।
বৈদেশিক মিশনগুলোতে কনস্যুলার সেকশনে নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া করতে কোনভাবেই রাজি নয় পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকের সিন্ডিকেট। একাধিক মিশনের কনস্যুলার সেকশনের দুর্নীতির ভাগ-বাটোয়ারার অংশীদার স্বয়ং পররাষ্ট্র সচিব, এমন অভিযোগ নতুন না হলেও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও ইদানিং তিনি নিজের আখের গোছাতেও মনোনিবেশ করেছেন সযত্নে। যে কোন কারণেই হোক, মিজারুল কায়েসের মতো বিপদে যদি তিনি কোনদিন পড়ে যান, সেক্ষেত্রে পুরনো অফিস আইওএম-এ ফেরার পাইপলাইন ক্লিয়ার করেছেন সম্প্রতি। তারই অংশ হিসেবে সুচতুর এই অফিসার অত্যন্ত নেক্কারজনকভাবে এযাত্রায় বলি দিয়েছেন গ্রীসের রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদকে।
এথেন্সের প্রতারক দালাল সিন্ডিকেটের লোভনীয় অফারে সাড়া দেয়া সেখানকার আইওএম নারী দোভাষীর মিথ্যা অভিযোগনামাকে সত্য প্রমাণে উঠেপড়ে লাগেন সচিব শহীদুল হক। তথাকথিত তদন্তের ফলাফল নিজেই আগেভাগে ঠিক করে রাখলেও সরকারের লাখ লাখ টাকা জলে ঢেলে লোকদেখানো তদন্তকমিটি করে গ্রীসে পাঠান তিনি নিজ উদ্যোগে। রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদকে ঢাকায় রি-কল নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে আইওএম-এর কাছে নিজের অবস্থান মজবুত করেছেন আইওয়াশে পারদর্শী সচিব শহীদুল হক। নোংরামি সফল করতে গ্রীসের দালাল সিন্ডিকেটের ঢাকাস্থ এজেন্ট বিএম জামাল হোসেনকে ইতিমধ্যে পুরষ্কৃত করেছেন সচিব শহীদুল হক।
২০০৯ থেকে ২০১২ এথেন্সে কাউন্সিলরের দায়িত্বে থাকা বিএম জামালকে নিয়ে এখন তিনি নিউ ইয়র্কে অবস্থান করছেনে প্রধানমন্ত্রীর সফরের অগ্রগামী দলের অংশ হিসেবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের কনস্যুলার এন্ড ওয়েলফেয়ার ইউনিটে থাকা বিএম জামাল (পরিচালক, এমআরপি) কীসের বিবেচনায় এখন নিউ ইয়র্কে, তা গ্রীসের বাংলাদেশ কমিউনিটিতেও আজ ‘ওপেন সিক্রেট’। তবে আইওএম-এ নিজের ‘ক্রেডিবিলিটি’ বাড়াতে সচিব শহীদুল হক নোংরামির খেলায় মেতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদের মতো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে যেভাবে ফাঁসালেন, তার জন্য একদিন অবশ্যই তাকে কঠিন জবাব দিতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।