মাঈনুল ইসলাম নাসিম : ‘‘আপনার ভাই তো তেমন কিছুই করতে পারেনি, তবে আমার কিন্তু যে করেই হোক কোটি কোটি টাকা চাই’’ – লেবাননের রাজধানীতে জনে জনে এমনটাই বলতেন অপসারিত রাষ্ট্রদূত গওসোল আযম সরকারের স্ত্রী সাদিয়া আযম। সহধর্মিনী হয়ে সুইডেনের পর লেবাননেও মূলতঃ তিনিই সর্বনাশ ডেকে আনেন স্বামীর ক্যারিয়ারে। বৈরুতে বাংলাদেশ নেভির এক অফিসারের সাথে প্রকাশ্যে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে রীতিমতো বুঁদ হয়ে ছিলেন কালো টাকার নেশায়।
নেভাল কমান্ডেন্ট আমিন খানের সাথে সাদিয়া আযমের পরকীয়া সম্পর্কের বিষয়টি লেবাননে ‘ওপেন সিক্রেট’ থাকলেও গওসোল আযম রাষ্ট্রদূত থাকাকালীন কেউ এ ব্যাপারে মুখ খোলার সাহস করতেন না। সবসময় ভয় কাজ করতো না জানি কখন সাদিয়া তার পোষ্য সুমন-কিরণ বিচ্ছুবাহিনীকে লেলিয়ে দেন পেছনে, না জানি রাষ্ট্রদূত গওসোল আযমকে দিয়ে দূতাবাস থেকে ফোন করে কাকে কখন পুলিশে ধরিয়ে দেন।
গত মাসে গওসোল-সাদিয়া-সুমন-কিরণ সাম্রাজ্যের পতনের পরপরই আলোর মুখ দেখতে শুরু করে রাষ্ট্রদূতপত্নী সাদিয়ার অন্ধকার জগতের লাল-নীল অধ্যায়। স্ক্যান্ডালের শুরুটা অবশ্য স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ক্যাপিটাল সুইডেন থেকেই। গত বছর রাজধানী স্টকহল্মে রাষ্ট্রদূতের সরকারী বাসায় বাংলাদেশ থেকে আনা গৃহকর্মী তৈয়বাকে সাদিয়া কর্তৃক নিয়মিত শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা সুইডিশ পুলিশের তদন্তে প্রমাণিত হবার পর তোলপাড় সৃষ্টি হয় স্থানীয় প্রশাসনে। নড়েচড়ে বসে সুইডশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সাদিয়া আযমকে দেয়া হয় দেশ ছাড়ার আল্টিমেটাম।
পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ সরকার তখন রাষ্ট্রদূত গওসোলকে সুইডেন থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে লেবাননে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ দূতাবাসে। এমন এক সময় গওসোল আযমকে লেবাননে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় যখন আগে থেকেই দেশটির আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল নির্যাতিতা হাজার হাজার বাংলাদেশি নারীদের কান্নায়। সুইডেনের ধকল সামলে রাষ্ট্রদূত গওসোল বৈরুতে স্বদেশী মা-বোনদের কান্না থামাবার আগেই আবার লাইমলাইটে চলে আসেন স্টকহল্ম থেকে বহিষ্কৃত সেই সাদিয়া।
এর আগে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দিপু মনির কৃপায় সুইডেন ফিনল্যান্ড ডেনমার্ক নরওয়ে ও আইসল্যান্ড এই ৫ টি গুরুত্বপূর্ণ দেশের বিশাল দায়িত্বে পররাষ্ট্র ক্যাডারের বেশ ক’জন সিনিয়র কূটনীতিককে ডিঙ্গিয়ে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রদূত হিসেবে গওসোল আযমকে স্টকহল্মে নিয়োগ দেয়া হয় তখন। ‘‘রাষ্ট্রদূত হলে কোটি টাকা কামানো যায়’’ এমন একটি ধারণা মূলতঃ সুইডেন থেকেই সাদিয়ার মাথায় ঢুকে যায় বা ঢুকিয়ে দেয়া হয়। স্টকহল্মে তার সাথে জানাশোনা ছিলো এমন একাধিক বাংলাদেশি ভদ্রমহিলা এই প্রতিবেদককে এমনটাই জানান।
তবে সুইডেনে ঠিক সেরকম কোন সুযোগ গওসোল বা সাদিয়ার জন্য না এলেও বহিষ্কৃত হবার পর লেবানেন এসে যেন রীতিমতো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে যান সাদিয়া। বৈরুতের প্রথম দিনগুলোতে বাঙ্গালি কমিউনিটির প্রভাবশালী বা অবস্থাসম্পন্ন যাকেই সামনে পেয়েছেন তাকেই আড়ালে ডেকে কোটিপতি হতে না পরার আক্ষেপের কথা শোনাতেন সাদিয়া আযম। লক্ষ্য অর্জনে প্রতিজ্ঞার কথা জানিয়ে একসাথে কাজ করার অফারও দিতেন সাদিয়া লোকজনকে।
অফার ফিরিয়ে দেয়া একজন এই প্রতিবেদককে জানান, ‘‘ম্যাডামের একটাই কথা ছিলো সবসময়, পৃথিবীর সব কিছুর বিনিময়ে হলেও আমার কোটি কোটি টাকা চাই’’। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বৈরুতের আমজনতাকে স্বাক্ষী রেখে গওসোলপত্নী সেই ‘ম্যাডাম’ কিন্তু কথার সাথে কাজের মিল রেখেই এগিয়ে যান লেবাননের মাটিতে। তার ডাকে সাড়া দেয় লেবাননেন ৩ চিহ্নিত স্মাগলার সুমন ভুইয়া ওরফে কারা সুমন, শহিদুল ইসলাম কিরণ ওরফে ম্যাসেঞ্জার কিরণ এবং ‘গডফাদার’ হোসেন চৌধুরী।
তিন প্রতারকের সাথে মাখামাখিতে রীতিমতো ‘গডমাদার’ বনে যান সাদিয়া। নিরীহ জনগনের ওপর শোষণ চালিয়ে পাসপোর্ট বানিজ্য তো ছিলোই, এমনকি দূতাবাস থেকে সরকারী পরিচয়ে বিভিন্ন কোম্পানিতে ফোনের পর ফোন দিয়ে ম্যানেজ করে ১ বছরে প্রায় দেড়শ’র বেশি লোক বাংলাদেশ থেকে লেবাননে নিয়ে আসে সাদিয়া এন্ড কোং। নিরীহ মানুষের মাথায় কাঠাঁল ভেঙ্গে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় তখন এই চক্র। কালো টাকার গন্ধ পেয়ে স্বামী গওসোল আযমকেও ধরে ধীরে অপাংক্তেয় মনে হতে থাকে সাদিয়ার।
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর লেবানন মিশনে নিয়োজিত জাহাজে কর্মরত কমান্ডেন্ট আমিন খানের সাথে দ্রুত সখ্যতা গড়ে ওঠে সাদিয়ার। আগে থেকেই হাতে পেয়ে যাওয়া বৈরুতের আকাশের চাঁদ নিয়ে এবার যেন স্বর্গে যাবার পালা। চুটিয়ে নয়, অনেকটা প্রকাশ্যেই নেভাল অফিসার আমিন খানের প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকেন সাদিয়া। স্বামী গওসোল আযম যখন দূতাবাসে অলস সময় অতিবাহিত করতেন, তখন সাদিয়ার ব্যস্ততা ছিল অন্যত্র।
দূতাবাসের লেবানিজ ও বাংলাদেশি ড্রাইভার দিনের বেলা অসংখ্যবার সাদিয়াকে একাকি ড্রপ করেছেন অনতিদূরে সমুদ্রতীরবর্তী অভিজাত ‘রৌশা’ এলাকার ‘মোভেনপিক’ হোটেল এন্ড রিসোর্টে। জাহাজ থেকে বেরিয়ে কমান্ডেন্ট আমিন খান আগে থেকেই অবস্থান করতেন ট্যুরিস্ট এরিয়ার এই বিলাসবহুল হোটেলটিতে। বৈরুতের বাংলাদেশিদের অনেকেই সাদিয়া ও আমিন খানকে কাছাকাছি সময়ে এমনকি একসাথেও ঐ আবাসিক হোটেল প্রবেশ করতে ও বেরিয়ে যেতে দেখেছেন। রাষ্ট্রদূত গওসোল প্রায়শঃই অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখতেন সাদিয়া নেই।
দূতাবাসের ড্রাইভার অফিস শেষে গওসোলকে বাসায় পৌছে দিয়ে গাড়ি রেখে চলে যাওয়ার কারণে বিকেলের পর বা সন্ধ্যায় নিজ ব্যবস্থাপনায় একাই বাসায় ফিরতেন সাদিয়া। তার সাথে অভিসারের দিনগুলোতেও আমিন খানও ছিলেন রীতিমতো দিশেহারা। জাহাজে ফিরে ভাইবারে রাতভর ম্যারাথন চ্যাট হতো সাদিয়ার সাথে তার। জাহাজে তার কয়েজন কলিগ এ নিয়ে কিছুটা জেলাস ছিল এবং বিশেষ কোন দিনে তাদেরই একজন সুযোগ বুঝে আমিন খানের মোবাইল থেকে সংরক্ষণ করার পাশাপাশি প্রিন্টআউট করে রাখে সাদিয়ার সাথে ভাইবার চ্যাটের অংশবিশেষ।
ভাইবার চ্যাটিং প্রিন্টআউটের পুরো কপি এই প্রতিবেদকের হাতে থাকলেও প্রায় অধিকাংশটাই প্রকাশের অনুপযুক্ত বিধায় বিশেষ বিবেচনায় তার সামান্য একটি অংশ এই প্রতিবেদনের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। সুদর্শন নেভাল অফিসার আমিন খানের সাথে পরকীয়ায় মজে সাদিয়া অবশ্য এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছেন। বৈরুত উপকুলে মিশনে থাকা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ঐ জাহাজটিতে বাংলাদেশি চাল-ডাল-তরিতরকারি সাপ্লাইয়ের লোভনীয় বিশেষ টেন্ডারটি আমিন খানকে দিয়ে সাদিয়া পাইয়ে দেন বৈরুতে তার নিজস্ব লোক চট্টগ্রামের হোলসেল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইসমাইল’কে।
বিগ এমাউন্টের এই টেন্ডার থেকে সাদিয়া রেগুলার পেতেন ভালো মার্জিনের কমিশন। কপালের লিখন যায় না খন্ডন, সাদিয়া এখন বাংলাদেশে। নৌবাহিনীর ঐ জাহাজটি মিশন শেষে চট্টগ্রাম ফেরায় আমিন খানও এখন বৈরুতে নেই। তবে ৩ সন্তানের জননী সাদিয়ার পরকীয়া প্রেম আর কালো টাকার নেশাই যে রাষ্ট্রদূত গওসোলের ক্যারিয়ারের বারোটা বাজিয়েছিল, তা এখন লেবাননে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’।