• u. Nov ২১, ২০২৪

আমিওপারি ডট কম

ইতালি,ইউরোপের ভিসা,ইম্মিগ্রেসন,স্টুডেন্ট ভিসা,ইউরোপে উচ্চ শিক্ষা

কেমন আছেন ইতালির পার্শ্ববর্তী দেশ ফ্রান্সে বাংলাদেশীরা?

ByLesar

Jun 29, 2014
মুহাম্মদ গোলাম মোর্শেদঃ প্যারিস উচ্চশিক্ষা, রাজনৈতিক আশ্রয়, বিভিন্ন বৃত্তিসহ নানা কারণেই শিল্প-সংস্কৃতির তীর্থভূমি ফ্রান্সে আগমন ঘটে বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর। শুরুতে এই সংখ্যা নেহাত হাতে গোনা হলেও বর্তমানে ফ্রান্সে বসবাসরত বাংলাদেশীর সংখ্যা ৪০ হাজারের কোঠায়।ফরাসি ভূখণ্ডে স্থানীয় প্রশাসন ও জনগোষ্ঠীর কাছে বাংলাদেশ ও বাঙালী নামটা এখন বিশেষ গুরত্ব বহন করে। এ দেশে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বসবাসরত মানুষের মধ্যে বাঙালী জনগোষ্ঠীই ফরাসিদের জীবনযাপন, পেশা, সরকারের আইনের প্রতি আনুগত্য, নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি, ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ইত্যাদি কারণে স্বতন্ত্র এক ভাবমূর্তি সৃষ্টি করেছে।

এখানে বসবাসরত বাঙালিদের অধিকাংশই রাজধানী প্যারিসে বসবাস করেন। এছাড়া তুলুজ, তুলোন, রেস্ট, মারছাইসহ ফ্রান্সের অন্যান্য শহরেও বেশ কিছু সংখ্যক বাংলাদেশীর বসবাস রয়েছে।

স্থায়ীভাবে বসবাসরত বাঙালিদের অধিকাংশই রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার মাধ্যমে ফ্রান্সে স্থায়ী হয়েছেন। এখানে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ফরাসি নাগরিক, বাংলাদেশী শরণার্থী, বাংলাদেশী অভিবাসী, রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদনপ্রার্থী বিভিন্ন পরিচযয়ে অনেকেই অবস্থান করছেন।

পেশাগত দিক থেকে ফ্রান্সে বসবাসরত বাংলাদেশীদের অধিকাংশই রেস্টুরেন্ট ব্যবসা ও রেস্টুরেন্ট সংশ্লিষ্ট পেশার সঙ্গে জড়িত। এছাড়া ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কর্মী, ট্যাক্সিচালক, ফোনকল ও আমদানি-রফতানি ব্যবসা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও অনেকেই সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। এখানকার প্রশাসনিক কর্মকান্ডের সবকিছুই ফরাসি ভাষায় পরিচালিত হয়ে থাকে। তাই অনেক বাঙালিই ফরাসি ভাষা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে আয়ত্ব করে অনুবাদকের পেশার মাধ্যমে কমিউনিটির মানুষের সেবার পাশাপাশি নিজেদের স্বনির্ভর করেছেন। তারা এই পেশাকে তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলছেন। পাশাপাশি আইন ব্যবসা, প্রশাসনিক কর্মী ও কর্মকর্তা এবং শিল্প-সংস্কৃতির মতো সৃজনশীল পেশায়ও বাঙালিরা স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল।

এখানকার প্রত্যেক বাঙালিই জন্মভূমি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বসবাস করলেও সবার বুকের এক কোণে বসবাস করে ছোট্ট একখণ্ড বাংলাদেশ। স্ব-স্ব পেশার পাশাপাশি শত ব্যস্ততার মধ্যেও নিজস্ব শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতি চর্চা ইত্যাদিতেও রয়েছে তাদের সরব উপস্থিতি। বাংলাদেশের মত এখানেও বাঙালীর চিরাচরিত অনুষ্ঠান—শহীদ দিবস, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস, পহেলা বৈশাখ, ঈদ, পূজা এবং অন্যান্য উৎসবগুলোর আনন্দ প্রবাসীরা মিলেমিশে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো যথেষ্ট উৎসাহ ও উদ্দীপনায় উদযাপন করে ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বরের মতো জাতীয় দিবসগুলো। এছাড়া রবীন্দ্র-নজরুল ও অন্যান্য কবি-সাহিত্যিকদের জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালন এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক কমিউনিটি সংগঠনগুলোর আয়োজিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেন এক দেশীয় আমেজের সৃষ্টি করে। এখানে যেসব সংগঠন উল্লিখিত উৎসব আয়োজনের উদ্যোগ নেয় তাদের মধ্যে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ, ইয়ুথ ক্লাব, একুশে উদযাপন পরিষদ, স্বরলিপি শিল্পী গোষ্ঠী, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, মাটির সুর, বাংলাদেশ ভিউ, কালচার প্লাস অন্যতম।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল চলচ্চিত্র ‘লাল টিপ’ ফ্রান্স প্রবাসী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কাজী এনায়েত উল্লাহর প্রযোজনা ও প্রবাসী স্বপন আহমদের পরিচলনায় প্যারিসেই নির্মিত হয়েছে। এছাড়াও অনেকেই ছোটপর্দার জন্য নাটক নির্মাণের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশের অনেক শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের বসবাস এই ফ্রান্সে। তাদের মধ্যে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ও একুশে পদকপ্রাপ্ত মূকাভিনেতা পার্থ প্রতীম মজুদার, একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ, স্বনামধন্য আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেন অন্যতম।

সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি অনেকেরই সাহিত্যচর্চার অভ্যাস রয়েছে। সাহিত্যপিপাসু প্রবাসীদের উদ্যোগে মাঝে মধ্যেই প্যারিস থেকে প্রকাশিত হয় গল্প, কবিতা ও ছড়া সংকলন।

প্রসঙ্গত, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও লালসালুখ্যাত ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ফ্রান্সের প্রবাস জীবনে বসেই রচনা করেছেন তার অনবদ্য গল্প, কবিতা ও উপন্যাস।

অবাধ তথ্য-প্রযুক্তির যুগে সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতায় এসেছে এক নতুন দিগন্ত। প্রবাসীদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, সফলতা-অর্জন ইত্যাদির সংবাদ এখন বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে একটি বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। ফ্রান্সপ্রবাসী বাঙালীদের নানাবিধ সংবাদ তুলে ধরার জন্য নতুন প্রজন্মের অনেক তরুণকেই দেখা যায় ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ক্যামেরা হাতে সংবাদ সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত হয়ে। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় সংবাদ পরিবেশনকারীদের উদ্যোগে প্যারিসে একটি প্রেস ক্লাব গঠনের চেষ্টা চলছে। অনেকেই প্যারিস থেকে নিয়মিতভাবে বাংলা পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা বের করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন।

প্রবাসী বাংলাদেশীরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরাসরি জড়িত না থাকলেও সমাজ ও রাজনীতি প্রসঙ্গে তারা যথেষ্টই সচেতন। দেশের যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ঘটনায় নির্বিকার বসে না থেকে বিভিন্নভাবে অর্থ সংগ্রহ করে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাছাড়া এখানে অনেক সাদা মনের প্রবাসী রয়েছেন, যারা প্রতিনিয়ত নিঃস্বার্থভাবে কমিউনিটির বিপদগ্রস্থ ও সমস্যাইয় আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।

আড্ডা দিয়ে ও খোশ গল্প করে সময় কাটানোয় বাঙালীদের যে বিশেষ জুড়ি রয়েছে, এখানে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালীও তার ব্যতিক্রম নন। প্যারিসের গারদো নর্থ, লাশাপেল, ক্যাথসীমা প্রভৃতি এলাকার রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে, বার ও ফুটপাতগুলো প্রতিদিনই জেগে ওঠে বাঙালিদের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক আলোচনা ও হাসিঠাট্টায়, যা ক্ষণিকের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেয় প্রবাস জীবনের দূরত্বের কষ্ট।

ফ্রান্সপ্রবাসী বাঙালিদের এখানে হাজারো সাফল্যগাঁথা, কর্মকাণ্ড ও প্রচেষ্টার পাশাপাশি রয়েছে বেশ কিছু প্রতিকূলতা। প্রথমত, প্রত্যেক বাঙালিকে এখানে এসে যুদ্ধ করতে হয় পৃথিবীর অন্যতম দুর্বোধ্য ফরাসি ভাষার সঙ্গে। অদক্ষ ভাষাজ্ঞানের কারণে প্রশাসনিক ও কর্মক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত হোচট খেতে হয় তাদের। অনেক ক্ষেত্রে কাজ হারিয়ে বেকারও হতে হয়। তাই নতুন করে যারা ফ্রান্সে বসবাসের কথা ভাবছেন, তাদের উচিত এখন থেকেই ফরাসি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের ওপর বিশেষ গুরত্ব দেয়া।

অনেক বাংলাদেশীকেই ফ্রান্সে আসার পর প্রথম প্রথম বেশ কিছু তিক্ত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় এবং মানবেতর জীবনযাপন করতে হয় শুধুমাত্র আইনগতভাবে চলার সঠিক দিক নির্দেশনা ও বৈধভাবে বসবাসের স্বচ্ছ্ব ধারণার অভাবে। অনেক সময় দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার নজিরও রয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্যারিসের বাংলাদেশী দূতাবাস ও কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের যৌথ প্রচেষ্টায় একটি বিশেষ সেবা বিভাগ খোলার বিষয়টি ভেবে দেখার সময় এসেছে।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো ফ্রান্সেও বেড়ে উঠছে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্ম। যাদের জন্ম এই ফ্রান্সের মাটিতেই এবং তাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি সবকিছু ফরাসি পরিমণ্ডলের মধ্যেই। এদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে ফ্রান্স সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্মে নিয়োগ পাচ্ছেন, যা বাঙালি কমিউনিটির প্রবাসীদের জন্য বড় সুসংবাদ।

তাছাড়া অনেক বাংলাদেশী নাগরিক এখানকার ফরাসি ও অন্য দেশের নাগরিককে বিয়ে করে সংসার করছেন এবং তাদের ঘরে জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠছে দ্বৈত নাগরিকত্বের প্রজন্ম। দুঃখের বিষয়, এখানে বেড়ে ওঠা এই প্রজন্মের অধিকাংশই শুদ্ধভাবে বাংলা বলতে, লিখতে, পড়তে এবং বুঝতে পারে না। এর কারণ বৃটেন, আমেরিকা, কানাডা ও অন্যান্য দেশে বাংলা শিক্ষার বিভিন্ন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হলেও এখনো ফ্র্রান্সের মাটিতে কোনো বাংলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এই নব প্রজন্মের অস্তিত্ব থেকে মুছে যাবে তাদের বাঙালিত্ব এবং হারিয়ে ফেলবে শেকড়ের সন্ধান। তাই অবিলম্ব বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় এবং কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের সম্মিলিত উদ্যোগে কিছু বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, যেন এই স্কুল থেকে প্রবাসে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম বাংলা শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা কবিতা, গান ও শিল্প-সাহিত্যচর্চার সুযোগ পায় এবং বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে পারে।

অদূর ভবিষ্যতে ফ্রান্সে বসবাসরত বাংলাদেশী প্রবাসীরা রেমিটেন্সের মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আরো বেশি অবদান রাখবেন, ফরাসি ভূখণ্ডে গড়ে তুলবেন তথ্য-প্রযুক্তি, মেধা ও জ্ঞাননির্ভর সমাজ। সুনাম ও আস্থার মাধ্যমে বাঙালীরা ফরাসি জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিজেদের বিশেষ একটি স্থান গড়ে নেবেন, এটাই প্রত্যাশা।

মুহাম্মদ গোলাম মোর্শেদ, ফ্রান্স প্রবাসী।

Lesar

আমিওপারি নিয়ে আপনাদের সেবায় নিয়োজিত একজন সাধারণ মানুষ। যদি কোন বিশেষ প্রয়োজন হয় তাহলে আমাকে ফেসবুকে পাবেন এই লিঙ্কে https://www.facebook.com/lesar.hm

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *