বৈধ কাগজপত্র না থাকায় শোষিতের হাহাকারে আকাশ বাতাস হয়েছে ভারী, চলেছে নির্যাতন, বিচারের বাণী কেঁদেছে নিরবে নিভৃতে। রাজধানী এথেন্স থেকে ২৬০ কিলোমিটার দূরবর্তি যে এলাকায় ২০১৩ সালের ১৭ এপ্রিল খামার মালিক নির্বিচারে গুলি চালিয়ে বাংলাদেশিদের আহত করেছিল, সেই ‘নেয়া মানোলাদা’ সহ তার আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে স্ট্রবেরি খামারগুলোত কাজ করছেন প্রায় হাজার পাঁচেক বাংলাদেশি। তাঁদের অধিকাংশেরই বৈধ কাগজপত্র না থাকার পরিণতিতে মালিকদের হাত করে স্বদেশী মাস্তুরা চক্র কায়েম করে শোষনের রাজত্ব।
খামারে একদিকে শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রম, অন্যদিকে দিন হিসেবে বেতন যা পেতে হবে মাস্তুরার হাত থেকে। একেক জন মাস্তুরার অধীনে শ্রমিক থাকে ২৫ থেকে ২০০ জন। মালিকের কাছ থেকে মাস্তুরা জনপ্রতি দৈনিক ২৫ ইউরো নিলেও এর মধ্য থেকে নিজের পকেটে ভরে জনপ্রতি ৩ থেকে ৫ ইউরো। অধীনস্ত শ্রমিকদের মাস্তুরা বাধ্য করে নিজস্ব বাসায় বা ম্যাসে থাকতে। এখানেই শেষ নয়, কলিং কার্ড বা সিগারেটটিও মাস্তুরার কাছ থেকে অতিরিক্ত মূল্যে কিনতো হয় সবার। প্রায়শঃই মালিকের কাছ থেকে ১৫ দিন বা এক মাসের বেতন উঠিয়ে অসাধু মাস্তুরা তা বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়, ফলে অনেক সময় মাসের পর মাস আটকে যায় মাথার ঘাম পায়ে ফেলা শ্রমিকদের বেতন।
অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে তাঁদের উপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। সুচতুর মাস্তুরা নিজস্ব ম্যাসে-বাসায় বা গ্রুপে তার বিশ্বস্ত কয়েকজন লোককে বাড়তি সুবিধা দিয়ে বিনামূল্যে লালন-পালন করে বাকিদের শায়েস্তা করতে। শোষনের আধিপত্য বজায় রাখতে কুখ্যাত এইসব মাস্তুরা ব্যবহার করে রাজধানী এথেন্সের বাংলাদেশি কিছু মুখচেনা রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক নেতাদের। তথাকথিত এই শ্রেনীর নেতারা সময়ে সময়ে মাস্তুরাদের শোষনকৃত অর্থের ভাগ বাটোয়ারায়ও অংশীদার হয়।
২০০৯ সালে এথেন্সে বাংলাদেশ দূতাবাস প্রতিষ্ঠার পর ২০১২’র শেষ অবধি দায়িত্ব পালনকারী রাষ্ট্রদূত সহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের চরম উদাসিনতায় ‘নেয়া মানোলাদা’ সহ আশপাশের এলাকায় কুখ্যাত মাস্তুরাদের রামরাজত্ব কায়েম হয়। সময়ের পরিক্রমায় ২০১৩ সালের গোড়ার দিকে এথেন্সে যোগ দেন রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ। নির্মম শোষণ-নির্যাতনের শিকার হাজার হাজার বাংলাদেশির জন্য ‘ত্রাণকর্তা’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তিনি। একাত্তরের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা গ্রীসের রাজধানীতে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই রক্তচোষা মাস্তুরাদের বিরুদ্ধে রীতিমতো ‘জেহাদ’ ঘোষণা করেন। নেয়া মানোলাদা সহ আশপাশের এলাকার স্থানীয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ সহযোগিতায় এবং দূতাবাসের কনস্যুলার সেকশানের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে মাস্তুরাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে সফলও হয়েছেন তিনি। ফলশ্রুতিতে শোষণ নেমে এসেছে আজ অর্ধেকে। শতকরা পঞ্চাশ ভাগের বেশি স্ট্রবেরি শ্রমিক এখন সরাসরি মালিকের কাছ থেকে বেতন নিচ্ছেন।
শ্রমজীবি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এবারের মহান মে দিবসের ঐতিহাসিক মুহুর্তে রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ তাই শুভেচ্ছা জানিয়েছেন শোষণ-নির্যাতনের শিকার বাংলাদেশি শ্রমিকদের। পহেলা মে এই প্রতিবেদকের সাথে একান্ত আলাপকালে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক সংগ্রাম অব্যাহত রাখার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি। রক্তচোষা মাস্তুরাদের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ। খেটে খাওয়া মেহনতী মানুষের স্বার্থ রক্ষায় গ্রীক প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে প্রয়োজনে আরো কঠোর হবেন বলে জানান তিনি। অবৈধ সুপারভাইজার তথা মাস্তুরাদের কবল থেকে নিরীহ বাংলাদেশিদের শতভাগ মুক্ত করতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাগুলোও রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ তথা এথেন্সের বাংলাদেশ দূতাবাসকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে ইতিমধ্যে।
উল্লেখ করা যেতে পারে, মাস্তুরাদের রামরাজত্ব তছনছ করে দেয়ার পাশাপাশি অকুতোভয় এই পেশাদার কূটনীতিক গত এক বছরে অত্যন্ত সাফল্যের সাথে ভেঙ্গে দিয়েছেন দূতাবাসকে ঘিরে আগের কয়েক বছরে গড়ে ওঠা পাসপোর্ট-দালালদের সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট।জালিয়াতি আর লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল এথেন্সের বাংলাদেশ দূতাবাস। দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ যোগসাজশেচিহ্নিত দালাল চক্র দূতাবাসের ভেতরে বাইরে গড়ে তুলেছিল পাসপোর্টপিসি, কেনা-বেচা, সার্টিফিকেট প্রদান সহ লক্ষ লক্ষ ইউরোর রমরমাবানিজ্য।
দালালদের সরাসরি প্রলোভন প্রত্যাখ্যান করে এবং শত প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ যে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছেন, তাতে করে গ্রীসের বাংলাদেশ দূতাবাস আজ কলংক মুক্ত। অর্ধেকের বেশি স্ট্রবেরি শ্রমিক সারাদিন রোদে পুড়ে বেলাশেষে কষ্টার্জিত বেতনের জন্য মাস্তুরাদের মুখপানে আর তাকিয়ে থাকে না। মাস্তুরা গং আর পাসপোর্ট-দালাল সিন্ডিকেটের শোষন-লুটপাটে ছন্দপতন ঘটায় রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ আজ নানাভাবে ষড়যন্ত্রের শিকার। এথেন্স থেকে এই দেশপ্রেমিক অফিসারকে সরাতে ঢাকায় অর্থ বিনিয়োগের কথাও কান পাতলে শোনা যায় এথেন্সের বাংলাদেশি অধ্যুষিত ওমোনিয়া এলাকায়। ষড়যন্ত্রকারী দালাল সিন্ডিকেট চক্রের স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারক মহল একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বকে দূর প্রবাসে খাটো করবে না বলেই খেটে খাওয়া শোষিত নির্যাতিত মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস।