তাহমিনা ইয়াসমিন শশী, ভেনিসঃ ইতাল ঐষী প্রেমের বার্তা নিয়ে চলে এসেছে সাওম বা সিয়াম সাধনার মাস। সাওম বা সিয়াম শব্দের আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা, থেমে যাওয়া। শরীয়তের পরিভাষায় সুবহেসাদিক থেকে সূযাস্ত পযর্ন্ত নিয়্যত সহকারে পানাহার, পাপাচার, কামাচারসহ সকল প্রকারের মিথ্যা, কপটতা, অপবিত্রতা, পরনিন্দা, প্রবন্চনা, অত্যাচার, ব্যাভিচার এবং অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকাকেই সাওম বা রোজা বলে।
রোজা রাখার নিয়ম সর্বযুগেই প্রচলিত ছিল। হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে আখিরী নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) পর্যন্ত নবী-রাসূলরা প্রত্যেকেই সিয়াম পালন করেছেন। হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষ থেকে রমজান মাসে রোজা রাখা ফরজ করা হয়েছে। ইসলামের পাঁচ খুটির মধ্যে রোজা হলো তৃতীয় খুটি।
সিয়াম হচ্ছে সাধনার মাস। সংযমের মাস। আত্মশুদ্ধির মাস। প্রতিপালকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের মাস। মানুষকে মাগফিরাতের দিকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এবং আত্মিক, নৈতিক ও চারিত্রিক কল্যানের নিমিত্তে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রোজাকে তার বান্দাদের উপর ফরজ করেছেন। তিনি এরশাদ করেন, হে ঈমানদারগন! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হলো যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে দেয়া হয়েছিল। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে সক্ষম হও। (সূরা বাকারা, ২ঃ১৮৩)। তিনি আরো এরশাদ করেন, রমজান মাসে মানুষের হেদায়েত এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য অসত্যের পার্থক্যকারীরুপে কোরআন অবতীর্ন হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসে রোজা পালন করে। (সূরা বাকারা,২ঃ১৮৫)।
রোজার দ্বারা প্রবৃত্তির উপর বিবেকের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ এর দ্বারা মানুষের পাশবিক শক্তি দমিত হয় এবং রুহানী শক্তি বৃদ্ধি পায়। ক্ষুধা ও পিপাসায় মানুষের জৈবিক ও পাশবিক ইচ্ছা কমে যায়। এতে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়, অন্তর বিগলিত হয়। রোজার দ্বারা মানুষের মনে এমন এক নুরানী শক্তি পয়দা হয়, যার দ্বারা মানুষ সৃষ্টির এবং বস্তুর গুঢ় রহস্য সম্বন্ধ্যে জানতে পারে। রোজার দ্বারা মানুষের দৈহিক সুস্থতা অর্জিত হয়। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের মতে, প্রত্যেক মানুষের জন্য বছরে কয়েক দিন উপবাস থাকা আবশ্যক। তাদের মতে, পরিমিত খাদ্য গ্রহণ স্বাস্থের জন্য খুবই উপকারী। সূফী সাধকের মতে, হৃদয়ের পরিচ্ছন্নতা অর্জনে পরিমিত খাদ্য গ্রহনের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। রোজা মানুষের পাশবিক, দানবিক, অসুন্দর, অপ্রেমকে দমন করে মানব প্রেম, দয়া-মায়া, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও দান-ক্ষয়রাতের প্রতি আকৃষ্ট করে। ভোগ-বিলাস, পশুত্ব ত্যাগ করে মানুষ হওয়ার, সাধারণ মানবিক দূর্বলতা রিপু, বল্গাহীন কামনা-বাসনা থেকে দুরে থাকার শিক্ষা দেয়। সুতরাং প্রত্যেক সক্ষম মুসলিম নর-নারীর উচিৎ রমজানে নিষ্ঠার সাথে রোজা পালন করা।
কেউ কেউ মনে করেন রোজা রাখলে মানুষ দূর্বল হয়ে পড়ে। অপুষ্টি দেখা দিতে পারে। আসলে সব ভুল- স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের মতে রোজা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। রোজা শরীরের অতিরিক্ত মেদ ঝরাতে সাহায্য করে। পক্ষান্তরে মাত্রাতিরিক্তি পানাহারের ফলে শরীরে বিভিন্ন রোগব্যাধি সৃষ্টি হয়। রোজা মানুষের আত্মা এবং দেহের জন্য ঢাল স্বরুপ। যারা দীর্ঘ দিন যে প্রাণীর মাংস বেশি খায় তাদের মধ্যে ওই প্রাণীর স্বভাব দেখা দেয়। ভেতরে পশুত্ব জেগে ওঠে। রোজা মানুষর মানের পশুত্বকে দমন করে মানবতাকে জাগ্রত করে। যেমন রোমান ক্যাথলিকরা শুকরের মাংস খায়। তাদের মধ্যে শুকরের অনেক বৈশিষ্ট দেখা যায়। যেমন, প্রকাশ্যে কামাচার। মনের এসব পশুত্বকে দমন করার জন্য রোমান ক্যাথলিকদেরও রোজার বিধান আছে। তারা টানা ৪০ দিন এবং সপ্তাহে অন্তত একদিন কোনো মাংস খেতে পারবে না। অন্যান্য খ্রিস্টানদেরও রোজার বিধান আছে। তারাও রোজার সময় মাংস এবং ভারী কোনো খাবার খেতে পারবে না। তবে হালকা খাবার খেতে পারবে। পূর্বের নবী রাসুল এবং তাঁদের কওমের উপর আরো শক্ত রোজার বিধান ছিল। টানা তিন দিন থেকে ৫ দিন পর্যন্ত রোজার বিধানের কথাও ইতিহাস থেকে জানাযায়। কোথাও কোথাও সেহেরী খাওয়ার কোনো নিয়ম ছিল না। শুধুমাত্র সন্ধ্যার পর ইফতারির বিধান ছিল। ইহুদিদের তাওরাতে পাওয়া যায় হযরত মুসা (আ) তুর পর্বতে ৪০ দিন-রাত রোজা রেখেছিলেন। তিনি এ সময়ে সকল প্রকারের পানাহার থেকে বিরত ছিলেন। (খরুজ, অধ্যায় ৩৪, আয়াত ২৭)
রমজান মাস মানুষকে সাম্য নীতি শিক্ষা দেয়।
রোযার ক্ষেত্রে আল্লাহ ধনী, গরীব, বাদশা, ফরিরের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ রাখেন নি। স্বক্ষম প্রত্যেক নর-নারী রোযা রাখবে এটাই বিধান। যাদের ওজর আছে তাদের জন্যও সুনির্দিষ্ট বিধান দেয়া আছে। শিশু, বৃদ্ধ, রুগ্ন, অসুস্থ, প্রসুতী বা হৃতুবতী নারী কে কখন রোযা রাখবে না সে বিষয়ও পরিষ্কার বিধান দেয়া আছে। যে মায়েদের শিশুরা স্তন বা বুকের দুধ পান করে রমজান মাসে সেই মা’দের বেশ চিন্তিত দেখা যায়। কি ভাবে তার শিশুকে স্তন দান করবেন? রোজা রেখে শিশুকে স্তন দান করা যাবে কি না? রোজা রাখার ফলে বুকের দুধ কমে যাওয়র সম্ভাবনা থাকে কি না? এমন অনেক প্রশ্ন করতে শোনা যায়। এক্ষেত্রে প্রথমেই একটা কথা বলে রাখি, ইসলাম কোনো জবরদস্তির ধর্ম নয়। ইসলামের প্রতিটি বিধান মানুষের কল্যানের জন্য। যেখানে অকল্যানের বিন্দুমাত্র সম্ভবনা আছে সেখানে ইসলামি বিধান প্রয়োগেরও বিশেষ ব্যবস্থা আছে। এ সব বিধান সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে অভিজ্ঞ আলেমদের সাথে আলোচনা করতে হবে অথবা নির্ভরযোগ্য ফতোয়ার কিতাব পড়তে হবে।
পৃথিবীতে ইসলাম একমাত্র পরীক্ষিত ধর্ম, যার মাধ্যমে নারীকে সর্বত্তোম সম্মান এবং মর্যাদা দেয়া হয়েছে। একদিন নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর কাছে তার এক সাহাবী এসে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আমার নবী আমি সর্বোপ্রথম কার হক আদায় করব? নবী (দ) বললেন, তোমার মার। ২য় বার সাহাবী প্রশ্ন করলেন তারপর? নবী (দ) উত্তরে বললেন, তোমার মার। ৩য় বার সাহাবী একই প্রশ্ন করলেন এবং নবী করীম (সঃ) বললেন, তোমার মার। সাহাবী (৪র্থ বার) আবার প্রশ্ন করলেন, তারপর? নবী (দ) এবার বললেন, তোমার বাবার। এথেকেই বোঝা যায় ইসলাম নারীকে কতোটা গুরুত্ব এবং মর্যাদা দিয়েছে। বলা হয়ে থাকে মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহ্শেত। সুতরাং মা’র অধিকার সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সংরক্ষণ করেছে ইসলাম। বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামগণ মনে করেন, মা রোযা রাখার কারনে যদি সন্তান দুধ না পায়, সন্তান ক্ষুধায় কষ্ট পায় সে ক্ষেত্রে ওই মা’র জন্য রমজান মাসের রোজা শিথিল করার বিধান আছে। তার পরেও যেসব মায়েরা রমজানের রোজা রাখা থেকে নিজেকে মাহরুম করতে চান না তাদের জন্য সুখবর হলো, বিজ্ঞান বলে রোজা রেখে শিশুকে দুধ পান করালে মা এবং শিশু, কারো কোনো ক্ষতি হয় না। মা যদি কিছুটা নিয়োম কানুন মেনে শিশুকে দুধ পান করান তবে বুকে দুধের কোনো ঘাটতি হয় না।
যেসব কারনে মায়ের বুকে দুধের ঘাটতি দেখা দিতে পারে সেগুলো হলো, (১) মা যদি মারাত্মক রকম অপুষ্টিতে ভোগেনঃ পুষ্টি সমস্যা আমাদের দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা। আর এ সমস্যার প্রধান শিকার হন শিশু এবং মায়েরা। তবে সব রকমের পুষ্টি সমস্যা বা পুষ্টিহীনতা মায়ের বুকের দুধ তৈরী করতে অন্তরায় সৃষ্টি করে না। সুতরাং মারাত্মক কোনো পুষ্টিহীনতা না থাকলে আপনি রোযা রাখতে পারবেন। আপনার সন্তানের দুধ পেতে কোনো সমস্যা হবে না। আপনার শিশুকে বার বার স্তন টানতে দিন। এতে প্রোল্যাকার্টিন নামক এক ধরনের হরমন তৈরী হবে আপনার শরীরে। যা বুকের দুধ তৈরী করতে সাহায্য করবে। পুষ্টিহীন মায়েদের উচিৎ প্রতিদিনকার খাবারের তালিকায় ৪৫০ ক্যালরি বেশি শক্তি দায়ক খাবার খাওয়া। কোনো প্রকারের অষুধ ব্যবহারের আগে অবশ্যই অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিৎ।
(২) আস্থার অভাবঃ আত্মবিশ্বাস থাকলে অনেক কঠিন কাজকে সহজ সাধ্য করা অসম্ভব কিছু নয়। অথচ এই আত্মবিশ্বাসের কারনে অনেক সহজ কাজও কঠিন হয়ে যায়। শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। দেখা গেছে মায়ের বুকে যথেষ্ট দুধ আছে, কিন্তুু আত্মবিশ্বাসের অভাবে মা মনে করেন তার সন্তান পর্যাপ্ত দুধ পাচ্ছে না। এক্ষেত্রে নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনুন, দেখবেন রোজা রেখেও আপনার শিশুকে পর্যাপ্ত দুধ পান করাতে পারবেন।
ইফতারের সময় তৈলাক্ত খাবার বর্জন করুন। বেশী করে পানি খান। শাক সবজি খান। সেহেরী ইফতারের তালিকায় সিজন্যাল ফলমূল রাখুন। প্রোটিন, শর্করা, লৈাহ, আমিষ যুক্ত অন্য সময়ের তুলনায় একটু বেশি খাওয়ার চেষ্টা করুন। কার্বোহাইড্রেট খাবার খেতে পারেন যা আপনার বাচ্চার দুধ সরবরাহের ক্ষেত্রে সাহায্য করবে। রাতের খাবারের সময় এক চামচ ভাত, এক কাপ ডাল, একটি কলা এবং হালকা তেল দিয়ে রান্না করা সবজি আপনাকে বাড়ি শক্তি যোগাবে। বেশি বেশি পানি, দুধ, কলিজা এবং লাউ খেতে পারেন। এতে আপনার পুষ্টিহীনতা দুর হবে।
আপনার শিশুর বয়স যদি ৬ মাসের কম হয় তবে আপনার বুকের দুধই তার জন্য যতেষ্ঠ। প্রতি ২৪ ঘন্টায় ৬ বারের বেশি প্রসাব করলে বুঝবেন আপনার শিশু পর্যাপ্ত দুধ পাচ্ছে। সাধারণত কোনো খাবাই আপনার জন্য নিষেধ নয়। মায়েরা সব খাবার খেতে পারবেন। ইফতারির পরে ঘুমের আগ পর্যন্ত ঘন ঘন বিশুদ্ধ পানি পান করুন। দেখবেন আপনার শিশুর দুধ পেতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
বেশীক্ষন বাচ্চার মুখে চুষনি দিয়ে রাখবেন না। রাবারের নিপল জীবাণুমুক্ত নাও হতে পারে। তাই চুষনি বেশীক্ষন মুখে রাখা নিরাপদ নয়। শিশুকে বোতলের দুধ খাওয়াবেন না। বাচ্চার বয়স ৬ মাসের বেশি হলে বুকের দুধের পাশাপাশি সবজি ও তাজা ফলমূল ব্লাইন্ড করে খাওয়াতে পারেন। মনে রাখবেন, ফ্রিজে রাখা খাবার বাচ্চাকে না খাওয়ানোই ভালো এবং আপনার শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য আপনার বুকের দুধের কোনো বিকল্প নেই। আপনি একটু সচেতন হলেই রোজা রেখেও আপনার শিশুকে দুধ খাওয়াতে পারবেন। বুকের দুধ তৈরীতে রোজা কোনো বাঁধার সৃষ্টি করে না। বরং মা এবং শিশুর শারিরিক সুস্থতা বৃদ্ধি করে।