দেয়ালের ওপাশের বাড়িটাই শিমু আপাদের ছিল। কি যে সুন্দর দেখতে ছিল সে! টানা চোখ দুটো সবসময় ঝলমল করতো। মেঘ কালো দীঘল চুল। গালে টোল ফেলে যখন হাসতো, তখন মনে হত জলতরঙ্গ বাজছে। তাদের বাগানের আম গাছের আম চুরি করতে যেয়ে কতবার যে ধরা পড়েছি! যখনি শিমু আপার দাদী লাঠি হাতে তেড়ে এসেছেন তখনি স্বর্গের দেবী হয়ে তাতে বাধা হয়েছে শিমু আপা।
“আহা দাদী, থাকনা। টুকুন টা লক্ষি একটা ছেলে, তাই নারে টুকুন? আয় এদিকে আয়…”
আমি লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নিচু করে এগিয়ে যেতাম। শিমু আপা আমার গাল টেনে চুলে হাত বুলিয়ে হাতে ক’টা আম ধড়িয়ে দিতো। তাই দেখে সাথে আসা বন্ধুরা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতো। ঘাড় পাকিয়ে ওদের দিক তাকাতেই মুখে হাত দিয়ে হাসি চেপে রাখতো। ওরা ভালো করেই বুঝতো, খেলার মাঠে আজ আর রক্ষে নেই। এভাবেই আম অথবা ফুল চুরির অজুহাতে রোজ বিকেলে যেতাম তাদের বাড়ি। বলতে বাধা নেই, শিমু আপাকে বেশ লাগত আমার। একদিন তো গাল নাক ফুলিয়ে বলেই ফেললাম,
“আমি কিন্তু বড় হয়ে তোমাকে বিয়ে করবো।“
এই শুনে সেদিন হেসে গড়িয়ে পড়েছিল সে। তার বাবা, মা, ভাইয়া আর দাদীকে ডেকে জানিয়ে দেয় আমার ইচ্ছার কথা। শিমু আপার মা মুখে আঁচল চেপে বলেন,
“অতো সহজ নাকিরে টুকুন বাবু, আমার মেয়েকে বিয়ে করতে হলে অন্তত বি.এ. পাশ করতে হবে তোকে হে… সবেতো ক্লাস থ্রিতে উঠেছিস।“
আমি মন খারাপ করে দৌড়ে চলে আসি। বাসায় এসেই মায়ের পিঠে ধিরিম ধিরিম কিল বসিয়ে কান্না জুড়ে দেই। আমার অভিমানের কারণ জানতে চাইতে মাকে চেঁচিয়ে বলি,
”আমি কিন্তু বড় হয়ে শিমু আপাকে বিয়ে করবো।”
মা আমার কথা শুনে ঠোট টিপে হেসে বলেন,
“আচ্ছা বাবা, যখন বিয়ের বয়স হবে করবিনে বিয়ে। এখন এতো কান্নাকাটি কেন? আগে শিমুর মতো বড় হয়ে নে। দুষ্ট ছেলে…“
সেদিন মায়ের কথা শুনে মনে মনে শান্তনা পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, হয়তো বড় হলে সত্যিই শিমু আপাকে বিয়ে করতে পারবো। কিন্তু একদিন টুপ করে তার বিয়ে হয়ে গেলো। ছেলে বিদেশে থাকে, তাকেও নিয়ে যাবে। শুনেই ভ্যা ভ্যা করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলেছিলাম। হা হা হা… ওটা ছিল আমার জীবনের প্রথম প্রেম। যখন ভাবি আমার সেই ছেলেমানুষি দেখে সবাই হাসত, আমাকে মিথ্যা বলে বলে বুঝ দিতো। তখন বেশ হাসি পায় আমার। আজ আমার সংসার হয়েছে। পরীর মতো রূপবতী এক নারী আমার জীবন সঙ্গিনী। মাঝে মাঝে শিমু আপার কথা ভেবে গাল লাল করি, নিশ্চয় এখন সে দাদী অথবা নানি হয়ে গেছে। কেমন হতো তার সাথে দেখা হলে আবার? নিশ্চয় কান ধরে বলত,
“কিরে দুষ্ট ছেলে, আজো আমায় বিয়ে করতে চাস নাকি হ্যাঁ…?”
তুলিকে শিমু আপার কথা বলতেই খিল খিল করে হেসে গড়িয়ে পড়েছে,
“ এ মা… ছোট বেলায় তুমি এত্ত বদ ছিলে… হি হি হি…”
তুলি আমার স্ত্রী।
যাইহোক, ছোট বেলার কথায় ফিরে আসি। শিমু আপার পর আমি প্রেমে পড়লাম এক বৃদ্ধার। কি আশ্চর্য হচ্ছেন নিশ্চয়? আসলে শিশু কালের প্রেম গুলো এমনি হয়। যা কিনা যেকোনো সময়, যার জন্য ইচ্ছা হৃদয়ে লালন করা যায়…
ঘটনায় ফিরে আসি। রোজ দল বেধে খেলতে যেতাম মাঠে। এক বিকেলের কথা, রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে দেখি, পড়ন্ত রোদ ভেঙ্গে একটি কুঁজো ছায়া গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। কাছে আসতেই অবয়ব স্পষ্ট হল। শুকনো জির জিরে শরীর, ভাঙ্গা চোয়াল, তামাটে চামড়া। ছেড়া একটি শাড়ি দিয়ে ঢেকে রেখেছে ছোট্ট শরীর। হাতে থালা, ভিক্কা করে সে। কৌতূহলী আমি জিজ্ঞেস করি,
“কোথায় থাক তুমি? কেন ভিক্কা কর?”
প্রশ্ন শুনে বৃদ্ধার মুখ মলিন হয়ে গেলো,
“ভিক্কা কি আর সখে করি বাবু। বিয়া কইরা ছেলে বউ আনছে ঘড়ে, সেই ঘড়ে এখন আমার জায়গা নাই।“
বলার মাঝেই টপ টপ করে চোখের জল গড়িয়ে পরছিল ভাজ পরা গাল বেয়ে। আমার প্রচণ্ড মায়া হল, কিন্তু কি বলবো কিছু বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকলাম। তিনি আবার বলতে লাগলেন,
“মাইরা ঘড় থাইক্কা বাইর কইরা দিসে। আল্লাহ্… “
গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বৃদ্ধা। আমার মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো। বড্ড মায়া হল তার জন্য। কিভাবে তাকে সাহায্য করা যায় সেই চিন্তা করতে থাকি, মাথায় বুদ্ধি এলো। তাকে ২ মিনিট দাড়াতে বলে দৌড়ে বাসায় এলাম, মা সবসময় তোষকের নিচে এক কোনে খুচরা টাকা পয়শা রাখতো। তার চোখ ফাঁকি দিয়ে ৫ টাকার একটা নোট সরিয়ে ছুটলাম বাইরে। বৃদ্ধাকে দেখা গেলো আগের মতোই দাড়িয়ে আছে। তাকে আবারও ২ মিনিট দাড়াতে বলে পাড়ার জুম্মন মামার দোকানে গিয়ে ৩ টাকা দিয়ে একটা বন রুটি আর ২ টাকা দিয়ে একটা কলা কিনলাম। ফিরে এসে তার হাতে দিয়ে বল্লাম,
“তুমি রোজ এসময় এখানটায় আসবে, আমি রোজ তোমায় একটি করে রুটি আর কলা দিবো, ঠিক আছে?”
সে চোখের জল মুছতে মুছতে মাথা কাত করে। তারপর হেটে চলে যায় দূরে কোথাও। হয়তো ভিক্কা চালিয়ে যেতে…
কিন্তু আমি কথা রাখতে পারিনি। এরপর কত বিকেল পেড়িয়ে গেছে, খেলার ছলে হাড়িয়ে গেছে। ভুলে যাই তার কথা। একদিন মনে পড়তেই দৌড়ে গেলাম রাস্তার মোড়ে। কিন্তু নাহ, সে ছিল না। হয়তো বার বার এসে ফিরে গেছে, অথবা বিশ্বাস করতে পারেনি এই ছোট্ট আমার কথা। যাই হোক না কেন, আমার মনের ভেতর তার স্মৃতি যে দাগ কেটেছে, তা আজীবন থাকবে। জানি অবুঝ ছিলাম, তবু অপরাধ বোধ প্রতিনিয়ত কষ্ট দেয়। শুধু মনে হয়, হয়তো বৃদ্ধা আমায় না পেয়ে ফিরে গেছে…
আফসোস, সে জানলো না কি গভীর মমতায় এক ছোট বালক তার মনের পবিত্র ভালবাসার ভাগ দিয়েছিলো তাকে।
মানুষের মন বড়ই আশ্চর্য| এখানে ভালোবাসার কত রূপ যে জাগ্রত! বাবা মায়ের জন্য ভালোবাসা, ভাই বোনের জন্য ভালোবাসা, স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয় সজন, বন্ধু…..আর কিছু অচেনা মানুষের জন্যও এই মনে ভালোবাসা বিদ্যমান|
মা বাবা’র জন্য ভালোবাসা এর মধ্যে অন্যতম | বিশেষ করে মা… এই ডাকের মধ্যেই তো কত শান্তি লুকোনো | মা বাবা হচ্ছে বট বৃক্ষের মত | সন্তান সেই বৃক্ষের ছায়ায় বেড়ে উঠে | একসময় সন্তান এই ছায়া ছেড়ে চলে গেলেও বট বৃক্ষ কিন্তু তার প্রসারিত ডালপালা নিয়ে অনড় থাকে | আহা, কত হতভাগা এই বৃদ্ধার ছেলে, যে কিনা তার মাথার উপর ছায়াটাকে সরিয়ে দিলো…
(সমাপ্ত)
তানিয়া সুলতানা
darun ekti golpo upohar dilen. asha kori aro golpo porte parbo