সখী ভালোবাসা কারে কয় -১
ভারতের আগ্রায় অবস্থিত একটি রাজকীয় সমাধির নাম তাজমহল। মুঘল সম্রাট তাঁর স্ত্রী বেগম আরজুমান্দ বানু, যিনি মমতাজ নামে অধিক পরিচিত তার স্মৃতি ধারণ করতেই অপূর্ব শিল্পশৈলীতে এই সমাধী মহল নির্মান করেন। সমাধীটির নির্মান কাজ শুরু হয় ১৬৩২ সালে। সম্পূর্ণ হয় ১৬৪৮ সালে। তাজমহলকে কেউ কেউ শুধু তাজ নামেও ডাকেন। মূঘল স্থাপত্যশৈলীর একটি আকর্ষণীয় নিদর্শন হিসেবে মনে করা হয় তাজমহল কে। এর নির্মানশৈলীতে পারস্য, তুরষ্ক, ভারতীয় এবং ইসলামী স্থাপত্যশিল্পের সম্মিলন ঘটানো হয়েছে। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক তাজমহল কে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। তখন একে বলা হয়েছিল- universally admired masterpiece of the world’s heritage.
তাজমহল মুঘল মুসলিম স্থাপত্য কীর্তিগুলোর মধ্যে ঐতিহাসিক অলংকার, একটি অনন্য কীর্তি। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য হিসাবে গণ্য করা হয় এটিকে। বলা হয়- symbol of love! বর্তমানে তাজমহলে ২ থেকে ৩ মিলিয়ন পর্যটক আসে। এর মধ্যে প্রায় দুই লক্ষ পর্যটক বিদেশী। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ভারতে আসে তাজমহল দেখতে। কেনো আসে এতো পর্যটক? শুধুই কী স্থাপত্য দেখতে? না, তারা আসে মমতাজ শাহজাহানের অমর প্রেম দেখতে। নিজেদের প্রেমের খুধা মেটাতে।
বিশ্বজুড়ে ইতিহাসের কালজয়ী সাক্ষী হয়ে আছে রোমিও জুলিয়েটের প্রেমকাহিনী। রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েটের কাহিনীকার হিসেবে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের নামটি জানা। কিন্তু আমাদের অনেকেরই হয়ত জানা নেই শেক্সপিয়র কাহিনীটি ধার করেছিলেন তার থেকে প্রায় ৩০ বছর আগের একজন ইংরেজ লেখক আর্থার ব্রুকসের দি ট্র্যাজিক্যাল হিস্ট্রি অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট নামের একটি কাব্যিক রচনা থেকে।
রোমিও জুলিয়েটদের প্রেমকাহিনী সংঘটিত হয়েছিল ইতালীর ভেরোনা শহরে। কিছুদিন আগে আমার এক বান্ধবীকে নিয়ে গিয়েছিলাম সেখানে। দেখে এলাম সেই বিখ্যাত রোমিও জুলিয়েটের বাড়ী। বইতে পড়েছি কিন্তু সরাসরি কখনো দেখা হয়নি, এবার দেখলাম। বইতে পড়ার সময় ভেবেছিলাম হয়ত কোনো কল্পকাহিনী। কিন্তুু না, এ কোনও কল্পকাহিনী নয়, নিরেট সত্য ঘটনা। না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না। এখনো হাজার হাজার প্রেমিক প্রেমিকারা প্রতিদিন ভেরোনায় আসে তাদের প্রেমকে অমর করে রাখাতে। তারা জুলিয়েটের বারান্দায় দাড়িয়ে পরস্পরকে আলিঙ্গন করে। জুলিয়েটের মূর্তি ছুঁয়ে ছবি তোলে। ভালোবাসার বন্ধন যেনো অটুট থাকে সেই প্রত্যাশায় ঝুলিয়ে দেয় ছোট ছোট তালা। বিশ্বেজুড়ে প্রেম ভালোবাসার হাজারো নিদর্শন আছে, আছে প্রতিক। এর মধ্যে পাশ্চত্যের প্রেমিক প্রেমিকাদের কাছে ভালোবাসার তালা লাগানো সব চেয়ে বেশি জনপ্রিয়। ইউরোপের অনেক ব্রিজ এখন ভালোবাসার তালা লাগানোর ব্রিজ হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। যেমন প্যারিসের একটা ব্রিজের নাম রাখা হয়েছে, লাভ লক প্যারিস। গোটা দুনিয়ার প্রেমিক প্রেমিকারা ওখানে যায় ভালোবাসার তালা ঝুলাতে। ভালোবাসায় মত্ত যুগল একটি তালার উপর তাদের নাম লিখে সেই তালা ব্রিজের রেলিং বা ল্যাম্পপোষ্টে লাগিয়ে দেয়। এরপর চাবিটি তারা ফেলে দেয় ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর বহমান স্রোতে। যেন আর কোনদিন খুঁজে না পাওয়া যায়। খোলা না যায় ওই ভালোবাসার তালা। ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো এই রীতি ইতালীতে দারুন জনপ্রিয়। ভেরোনার যেখানে রোমিও জুলিয়েটরা অন্তরঙ্গ সময় কাটিয়েছেন সেই বিখ্যাত স্থানটির আশেপাশে ভালোবাসার তালা লাগানোর ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন। ইতালীতে একটা প্রবাদ আছে, ভাগ্যের কারনে একসঙ্গে মিলিত হয় দুটো মানুষ আর সারা জীবনের জন্য হৃদয়ে জোড়া লাগে। আমারও খুব ইচ্ছে হলো ভালোবাসায় তালা লাগাতে। কিন্তু হায়, কাকে নিয়ে লাগাবো তালা? এখানে তো কেউ একা একা তালা লাগায় না। কি আর করা, সবাই তালা ঝোলাচ্ছে জোড়া বেধে। আমারতো আর জোড়া নেই তাই চোখ দিয়ে উপভোগ করলাম ওদের তালা ঝুলানোর দৃশ্য। বান্ধবী আমাকে রোমিও জুলিয়েটের একটা পাথুরে সুভেনির গিফট করল। আমি সেই খুশীতে তালা ঝুলানোর বিষয়টা ভুলে গেলাম।
রোমিও জুলিয়েটের পুরো বাড়ীটা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলাম। দেয়ালে ঝুলানো রোমিও জুলিয়েটদের শৈল্পীক ছবিগুলো যেন এক একটি ভালোবাসার জীবন্ত প্রতিক। মনে হয় ছবিগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে অনেক কথা, অনেক প্রেম, অনেক ইতিহাস। কবির ভাষায় বললে বলা যায়, তুমি অনেক কথাই যাও যে বলে কিছু না বলে। ফ্লাস দিয়ে ছবি তোলা নিষেধ ছিল। আমার বান্ধবী প্রশ্ন করল, বলত কেন ফ্লাস দিয়ে ছবি তোলা যাবেনা? আমি কিছুক্ষন চুপ থেকে বললাম, জানিনা। তখন সে বিড়বিড় করে নিজের ভাষায় কি যেন একটা বলল, ঠিক বুঝলাম না। মনে হয় মূর্খ টুর্খ বলেছে! অবশেষে ফেরার পালা। ভিড় ঠেলতে ঠেলতে রবী ঠাকুরের ঐ গানের কথা মনে হল- সখী ভালোবাসা কারে কয়!
সখী ভালোবাসা কারে কয় -২
এইত সেদিন পাদোভা ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়ার পথে হঠাৎ পেছন থেকে একটা ডাক শুনতে পেলাম। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম একটা মেয়ে আমার দিকেই আসছে। আমাকে প্রশ্ন করল, আপনি কি বাঙ্গালী? উত্তরে বললাম, হ্যা। এবার মেয়েটি বলল, কলকাতার বাঙ্গালী? আমি বললাম না, একদম খাটি বাংলাদেশের বাঙ্গালী। মেয়েটি হেসে তার নাম বলল, সনি। এই ভার্সিটিতেই ইকোনোমিক্স প্রথম বর্ষে পড়ছে। জানতে চাইলো আমি কী পড়ছি। বললাম, ফিজিওথেরাপি, ২য় বর্ষ। যদিও আমি সবসময় এখানে আসিনা, মানে আসতে হয় না। ভেনিসে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা শাখা আছে। সেখানেই ক্লাস করার সুযোগ আছে। শুধুমাত্র পরীক্ষার সময় পাদোভায় আসতে হয়। সনির সাথে কথার পর্ব শেষ করে বিদায় নিতে যাবো ঠিক তখনি কে যেন ওর নাম ধরে ডাক দিল। আমরা দুজনে একসাথে তাকিয়ে দেখি সাদা চামড়ার একটা লোক সনির দিকে এগিয়ে আসছে। সনি একটু হেসে বলল উনি আমার দুলাভাই, আমাকে নিতে এসেছেন। আমি একটু মজা করে বললাম, আপন দুলাভাই, নাকি পাতিয়েছেন! সনি বলল, আপন বড় বোনের স্বামী। সাদা চামড়ার লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আসসালামুআলাইকুম। আমি সনির দুলাভাই, চলেন এক সাথে কফি খাই। তার বলার আন্তরিকতা দেখে আমি ‘না’ করতে পারলাম না। একজন ভীনদেশির মুখে নিজের ভাষায় কথা শুনে ভালোলাগায় আমার মনটা ভরে উঠল। কফি পান করতে করতে জানতে চাইলাম কেমন কাটছে আপনাদের বৈবাহিক জীবন? আর কি ভাবে একজন বাংলাদেশী মেয়েকে খুজে পেলেন বউ বানাতে? ইতালিয়ান এবং বাংলাদেশের ভাষা, সংষ্কৃতির কোথাও তো মিল নেই। দুটো একদমই আলাদা। কিভাবে ম্যানেজ করছেন সবকিছু? একই ভাষায় কথা বলে, একই দেশে জন্ম নিয়ে, একই সংস্কৃতিতে বড় হয়েই তো মানুষ এখন মানিয়ে নিতে পারছে না। অথচ আপনাদের কোনো কিছুতেই মিল নেই, রং, চেহারা, ভাষা, সংস্কৃতি সব কিছুই তো আলাদা, কি করে সংসার করছেন আপনারা? কথাগুলো বলতে বলতে আমার চোখের সামনে ভেষে উঠলো আমাদের দেশের এক ভয়াল চিত্র। সেখানে হিন্দি সিরিয়ালের মতো অসম প্রেম, প্রতারণা, পরকীয়া, তালাক বেড়ে চলেছে জ্যামিতিক আকারে। প্রতিদিনের পত্রিকা খুললেই দেখা যায় ভালোবাসার নামে নানা ভাবে প্রতারিত হয় মেয়েরা। ভন্ড প্রেমিকদের খপ্পরে পড়ে ধর্ষনের শিকার হয় তারা। ঘরে ঘরে পরোকীয়া এখন একটা ফ্যাসানে পরিণত হয়েছে। এক ঢাকা শহরেরই নাকি প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার তালাকের আবেদন জমা হয়। অথচ এখানে এক ইতালিয় যুবক ভালোবেসে সংসার করছে এক বাংলাদেশি নারীর সাথে।
আমার এতোগুলো প্রশ্নের উত্তরে মাত্র একটা শব্দ খরচ করলেন সানির দুলাভাই। তা হলো- ভালোবাসা। বাংলা এবং ইতালীয়ান ভাষার মিশ্রনে বললেন, ভালোবাসার কোনো রং নেই, কোনো গন্ডি নেই। আমি একটু অবাক হলাম। ইতালীর মত দেহজ সংস্কৃতির দেশের কোনো লোক যে এরকম ভালোবাসার কথা বলতে জানে আমার জানা ছিল না। তাদের ভালোবাসার কথা জানতে আমার কৌতুহল আরো বেড়ে গেল। আমি বললাম কিভাবে আপনাদের ভালোবাসার শুরু হলো? সনির দুলাভাইর নাম আদি। আদির খুব কষ্ট হচ্ছিল বাংলায় কথা বলতে। অনেক শব্দই খুজে পাচ্ছিলেন না। আমি বললাম আপনি চাইলে আমার সাথে ইতালীয়ান ভাষায় কথা বলতে পারেন। আদি বাংলাতেই কথা বলতে চাইলেন। কারন হিসাবে জানালেন তার ভালোবাসার মানুষ বাংলায় কথা বলে। আমি বিস্মিত হলাম। বুঝে গেলাম, সখী ভালোবাসা কারে কয়!
আদি ছিলেন সনির শিক্ষক। একদিন আদি সনিদের বাসায় পড়াতে এলেন। এসে দেখেন সনি এবং সনির পরিবার কান্নাকাটি করছে। সনির মন খুব খারাপ, ওনদিন সে পড়বেনা বলে আদি কে জানিয়ে দিল। আদি জানতে চাইলেন কেন তাদের মন খারাপ। সনি বলল, বাংলাদেশে তার বড় বোন ছবির স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়েছে। আদি বললেন, ডিভোর্স হয়েছে তাতে মন খারাপের কি আছে? এটাতো একটা অতি সাধারন বিষয়, যেকারো হতে পারে। সনি তখন আদিকে বুঝিয়ে বলে ডিভোর্সকে আমাদের ধর্ম, সমাজ এবং সংস্কৃতিতে কিভাবে দেখা হয়। আর তাছাড়া একটা মেয়ের জীবনে ডিভোর্স খুবই অপমান জনক বলে আমরা মনে করি। সনির বোনের একটা ছেলে আছে। কিভাবে তার ভরন পোষন জোগাবে আর কিভাবেই চলবে সনির বোন ছবির জীবন? আদি সব শুনে ছবিকে শান্তনা দেয়ার জন্য সনির কাছ থেকে ফোন নম্বর নেয়। সেখান থেকেই গল্পের শুরু।
টেলিফোনের কথা আস্তে আস্তে প্রেমে রুপান্তরিত হয়। ছবির টানে আদি ছুটে যান বাংলাদেশে। নিজের ধর্ম ছেড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন এবং ছবিকে বিয়ে করেন। ছবিকে নিয়ে আসে ইতালীতে। ছবি আহামরি কোনো সুন্দরী নারী নয়, সাথে একটা বাচ্চাও আছে। কোন কিছুই অন্তরায় মনে হয়নি আদির কাছে। কারন আদি ছবিকে ভালোবাসেন। আদি-ছবি খুব সুখী, ওদের ভালোবাসার কাছে ভাষা, ধর্ম, বর্ণ কোনও কিছুই বাধা হয়ে দাড়াতে পারেনি। আমার আরো একবার মনে হলো- সখী ভালোবাসা কারে কয়!
তাহমিনা ইয়াসমিন শশী
ভেনিস থেকে
শশী, আপনি সুন্দর লিখেছেন, আসলে আমরা জীবনে যে কি চাই মাঝে মাঝে সেটাই বুঝতে পারিনা, ভালোবাসা তো দুরের কথা।। কিন্তু এই পৃথিবীর মাঝেই আছে ভালোবাসার অনেক রূপ আমরা তা জানিনা ! ধন্যবাদ লেখককে উনার লিখার জন্য…