মাঈনুল ইসলাম নাসিম : সৌর ও বায়ুশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও বাসা-বাড়ি ও কলকারখানায় উন্নত জ্বালানী ব্যবস্থাপনা, অপচয় রোধ সহ জ্বালানীর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে ডেনমার্কের সবুজ প্রযুক্তি (গ্রীন টেকনোলজি) বাংলাদেশে নিয়ে যেতে কাজ শুরু করেছে কোপেনহেগেনে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ দূতাবাস। দেশটির সাথে বাংলাদেশের বছরে ৮০০ মিলিয়ন ইউএস ডলারের দ্বিপাক্ষিক বানিজ্য থাকলেও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সহ মূলত ডেনিশ প্রযুক্তিতে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করাকেই প্রধান টার্গেট হিসেবে নিয়েছেন দায়িত্বরত রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ আবদুল মুহিত। গেল সপ্তাহান্তে এই প্রতিবেদকের সাথে তাঁর একান্ত আলাপচারিতায় উঠে আসে ডেনমার্ক-বাংলাদেশ সম্পর্কের নানান দিক।
রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ আবদুল মুহিত বলেন, “ডেনমার্ক আমাদের পরীক্ষিত এবং বিশ্বস্ত বন্ধু, কারণ আমাদের স্বাধীনতার সময়ও আমরা ডেনমার্কের জনগনের কাছ থেকে নৈতিক সমর্থন পেয়েছি এবং স্বাধীনতার পর প্রথম যে কয়েকটা দেশ আমাদেরকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, ডেনমার্ক তার মধ্যে একটা। ঢাকায় ১৯৭২ সালে ডেনমার্ক তাঁদের দূতাবাস স্থাপন করেছে, যেটা খুবই এক্টিভ এবং বিশ্বমানের দূতাবাস। তারপরে গত ৪৩-৪৪ বছরে আমরা দেখেছি তাঁরা সবসময় আমাদের সহযোগী হয়েছে। নানান আন্তর্জাতিক সংকট যেমন জলবায়ু পরিবর্তন সহ বিভিন্ন ইস্যুতে ডেনমার্ক সবসময় আমাদের পাশে ছিল। এখনও তাঁদের যে দৃশ্যমান আগ্রহ, বিশেষ করে কোপেনহেগেনে আমাদের দূতাবাস স্থাপন হওয়ার পর এটা আরো অনেক বেশি বৃদ্ধি পাবে এবং পাচ্ছে বলে আমরা দেখতে পাচ্ছি”।
রাষ্ট্রদূত জানান, “ইউরোপে ডেনমার্ক আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন উন্নয়ন সহযোগী বন্ধুরাষ্ট্র। দু’দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের দীর্ঘদিনের ধারাবাহিকতার প্রেক্ষাপটেই গত বছর এখানে আমাদের দূতাবাস খোলা হয়েছে। তাঁদের সাথে আমাদের দ্বিপাক্ষিক বানিজ্য যে খুব বেশি তা নয়, ৮০০ মিলিয়ন ডলারের মতো বছরে। এর মধ্যে আমাদের রপ্তানি প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার এবং ডেনমার্ক থেকে আমরা আমদানী করি ১০০ মিলিয়ন ডলারের পন্য। বানিজ্যের পরিমানটা খুব একটা বিশাল আমি বলবো না, এর কারণ হতে পারে ডেনমার্ক কিন্তু ছোট একটা রাষ্ট্র জনসংখ্যার দিক থেকে। মাত্র ৫৫ লক্ষ জনগন তাঁদের। আমরা যে ৭০০ মিলিয়ন ডলারের পন্য রপ্তানি করি তার ৯০ শতাংশ হচ্ছে তৈরী পোশাক, যেটা ডিউটি ফ্রি বা শুল্কমুক্ত সুবিধা এখানে পেয়ে থাকে”।
রাষ্ট্রদূত মুহিত আরো বলেন, “আরএমজি ছাড়াও আমাদের নন-ট্রেডিশনাল আইটেম যেমন ঔষধ সামগ্রী, সিরামিক, পাটজাত পন্য এগুলোর রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য আমরা চেষ্টা করছি। ডেনমার্কে ইতিমধ্যে আমরা সমুদ্রগামী কয়েকটি জাহাজও রপ্তানি করেছি। রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য আমি উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখি এখানে, কিন্তু ডেনমার্ক যেহেতু ছোট একটা দেশ এবং কম জনসংখ্যার কারণে হয়তো সেই সম্ভাবনাটা সীমাহীন নয়। সেজন্য এখানে আমাদের দূতাবাসের প্রধান টার্গেট হচ্ছে বিশ্বব্যাপী যে সবুজ ইস্যুগুলো রয়েছে যেমন নবায়নযোগ্য জ্বালানী শক্তি, জ্বালানি সাশ্রয় ও দক্ষতা বৃদ্ধি, দক্ষ ব্যবস্থাপনা সহ যে কোন সবুজ প্রযুক্তিতে ডেনমার্ক যেহেতু পৃথিবীর প্রথমসারির দেশের একটা, তাই বাংলাদেশের আজকের ও আগামীর প্রেক্ষাপট এবং প্রয়োজনে ডেনমার্ক আমাদের জন্য অমিত সম্ভাবনার দেশ হতে পারে”।
ডেনমার্কের সবুজ প্রযুক্তি, সবুজ জ্ঞান, শিল্পায়নের সবুজ সমাধান, এই জিনিসগুলো বাংলাদেশে নিয়ে যাবার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ আবদুল মুহিত বলেন, “জলবায়ু বিপর্যয়গ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রয়োজন পূরণে ডেনমার্ক হতে পারে আমাদের আদর্শ বন্ধুরাষ্ট্র। সবুজ প্রযুক্তি বলতে আমি শুধু সৌরশক্তি বা বায়ুশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেই বোঝাচ্ছি না। এর মধ্যে আছে জ্বালানী ব্যবস্থাপনা, জ্বালানী অপচয় রোধ, জ্বালানীর সর্বোচ্চ ব্যবহার। আমাদের দেশে শিল্পকারখানা ও বাড়িঘরে যেহেতু প্রচুর জ্বালানী অপচয় হয়, এক্ষেত্রে ডেনমার্কের অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমরা কিন্তু চাইলে প্রচুর জ্বালানী সাশ্রয় করতে পারি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের জনগনের স্বাস্থ্যের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে আমাদের ফুড সিকিউরিটির। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা যেহেতু ক্রমাগতই হুমকির মধ্যে থাকবে, তাই ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে এদের যে সবুজ প্রযুক্তি রয়েছে, সেটাও নিয়ে যেতে হবে বাংলাদেশে”।
সবুজ ইস্যুতে সবুজ প্রযুক্তি নিয়ে ডেনমার্কের সাথে কাজ করার অপুর্ব সুযোগ বাংলাদেশের জন্য তৈরী হয়েছে এখন দূতাবাস প্রতিষ্ঠার কারণে, এমনটাই জানান রাষ্ট্রদূত মুহিত। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ইতিমধ্যে ৭০টি ডেনিশ কোম্পানি বাংলাদেশে রেজিস্টার্ড হয়েছে এবং তাঁদের বিপুল আগ্রহ রয়েছে মূলত দু’টো কারণে। প্রথমত আমাদের বিপুল চাহিদা আছে আর দ্বিতীয়ত আমাদের এখন যে আর্থসামাজিক সক্ষমতা, এতে করে যে কোন ডেনিশ সহযোগিতা বা বিনিয়োগ এমনকি সরকার টু সরকার সহযোগিতার ক্ষেত্রেও আমরা কিন্তু একটা ‘উইন-উইন’ অবস্থা অফার করতে পারি তাঁদেরকে। একতরফার দিন শেষ। একটা সময় ছিল আমরা খুব বেশি বিদেশী সাহায্যনির্ভর ছিলাম। তারপর আমরা বলতাম ‘নো এইড, ট্রেইড’। এখন আমরা জোরেশোরেই বলছি ‘নো এইড, ট্রেইড এন্ড ইনভেস্টমেন্ট। সক্ষমতার জন্য বাংলাদেশ তাই হতে পারে অত্যন্ত আকর্ষনীয় একটি ইনভেস্টমেন্ট স্টেশন”।
রাষ্ট্রদূত মুহিত বলেন, “বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে ১০০টি বিশেষ ইকোনমিক জোন বা অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরী করছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার বিদেশী বিনিয়োগ আমরা আশা করছি ডেনমার্ক সহ সারা পৃথিবী থেকে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ৩৩টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ চলছে এবং ২০১৭ সালের মধ্যে ১০টি কিন্তু রেডি হয়ে যাবে। ডেনিশ বিনিয়োগকারীদের জন্য এটা খুব ভালো সুযোগ তৈরী করবে বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য”। কোপেনহেগেনে বাংলাদেশ দূতাবাস প্রতিষ্ঠার পর বেশ কয়েক দফায় মন্ত্রী পর্যায়ের সফর হয়েছে উভয় দেশেই। গত অক্টোবরে শিল্পমন্ত্রী এবং সাম্প্রতিককালে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ডেনমার্ক সফর করেন। ডেনিশ সরকারের তরফ থেকে থেকে গত ১ বছরে ৩ বার মন্ত্রী পর্যায়ের সফর হয়েছে ঢাকায়।
চলতি বছর দু’দেশের মধ্যে প্রথমবারের মতো পরাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে ফরেন অফিস কনসালটেন্সি (এফওসি) বৈঠক আয়োজনের কাজ চলছে বলে জানান রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ আবদুল মুহিত । তিনি বলেন, “এটি হয়ে গেলে অদূর ভবিষ্যতে আরো হাইপ্রোফাইল ভিজিটের ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। চেষ্টা করবো আমার দায়িত্বপালনের সময়ে যাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডেনমার্কে সরকারী সফরে আসতে পারেন”। বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত জানান, “দূতাবাস প্রতিষ্ঠার পর ডেনমার্কে বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার নতুন সুযোগ তৈরী হচ্ছে। বিষয়টি ক্রমাগত ফলোআপ করা প্রয়োজন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যাওয়া এবং আলোচনায় বসা, যেটা আমরা ইতিমধ্যে শুরু করেছি। দূতাবাস না থাকার কারনে এতোদিন এটা সম্ভব হয়ে উঠেনি। বছরখানেকের মধ্যেই ভালো কিছু আমরা আশা করতে পারি”।