আদনান সাদেক জার্মানঃ উত্তরঃ পূর্বকথাঃ জার্মানিতে যখন ২০০২ সালে আসি, তখন ব্লক একাউন্ট বলে কিছু ছিল না। শুধুমাত্র বাবা চাচার ব্যাংক স্টেটমেন্ট দিয়ে কাজ হতো। জার্মানিতে আসার পর যখন ভিসা বাড়াতে গেলাম, তখন একটু ঝামেলা করল। কিন্তু সেটা শুধুমাত্র একটা এফিডেফিট দিয়ে সামলানো গেল। এফিডেফিটে বাবার ব্যাংক একাউন্টের পঞ্চাশ টাকার দলিলে নোটার সত্যায়িত ছাড়া আর কিছু লাগল না। ঝামেলার মধ্যে যেটা করল, সেটা হল সব এফিডেফিট কাগজ জার্মান ভাষাতে অনুবাদ করতে হল, সত্যায়িত করা সহ।
গত এক যুগে এই সত্যায়িত কাগজের উপর জার্মান এমব্যাসির ( উভয় ঢাকা এবং জার্মানিতে) আস্থা ধীরে ধীরে কমেছে। এর কারণ আর কিছু নয়, ব্যাংকে এক পয়সাও না রেখে ভুয়া কাগজে কোটি টাকার ব্যাংক স্টেটমেন্ট একাধিক বার কর্তৃপক্ষের কাছে ধরা পড়া। অন্যদিকে অনেক ছেলেপেলে এখানে এসে (এদের বেশীরভাগই ভাষা শেখার নাম করে ভিসা পেয়েছিল) ভাষা শেখাত দুরের কথা, পাসপোর্ট ফেলে দিয়ে জার্মান সরকারের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে বসলো। এদের অনেককেই অস্থায়ী ভাবে জার্মান সরকার মাসে মাসে ভাতোয়া দিয়ে পুষতে বাধ্য হয়েছে। জার্মানিতে আসার পর খরচ চালাতে না পেরে স্থানীয় এনজিও সহ বিভিন্ন দাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে হাত পাতার ঘটনাও আছে অনেক।
জার্মানিতে পড়াশোনা আমেরিকা কানাডার মতনই উন্নত হবার পরও বিনামূল্যে বিতরণ হয়। একজন ছাত্র বাংলাদেশ থেকে জার্মানিতে ফ্রি পড়তে আসলে জার্মান সরকারের আসলে কোন লাভ নেই। সুতরাং এরা চায়, এই সুযোগ যেন ছেলেমেয়েরা সততার সাথে নেয়, এবং শুধুমাত্র পড়াশোনা করার জন্যই জার্মানিতে আসে। এরমধ্যে ভুয়া ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেয়া, এখানে এসেই বদলে যাওয়া এবং অবশেষে ঘাড়ের উপর ভূত হয়ে চেপে বসা – এইসব পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য বাধ্য হয়ে জার্মান সরকার বাংলাদেশের মতন দেশগুলোর জন্য ব্লক একাউন্টের ব্যবস্থা চালু করেছে। প্রথমে তারা আমাদের বিশ্বাস করেছে, এখন আর বিশ্বাস নেই। সুতরাং আগে এক বছরের খরচের টাকা জার্মানিতে পাঠাও এবং তারপর অন্য কথা।
এমনকি বাংলাদেশের কিছু ব্যাংক টাকা খেয়ে গত বছর পর্যন্ত ব্লক একাউন্টের টাকা তুলে দিয়ে দিচ্ছিল ছাত্রদের হাতে ভিসা হয়ে যাবার পর। মূলত বিএসবি বা ভিসা ওয়ার্ল্ডের মতন দালালদের সহযোগিতা এবং এমব্যাসি ও গোয়েথের কিছু কর্মচারীর যোগসাজশে এই অসৎ কর্মকাণ্ড চলেছে এবং এখনও চলছে বলে অভিযোগ আছে।
ফলাফল, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোকেও আর বিশ্বাস করা হচ্ছে না। ব্লক একাউন্টের টাকা জার্মানিতে পাঠানোর পর জার্মান ব্যাংকে আবার এক বছরের জন্য আটকে রাখতে হয়। সব মিলে প্রায় ৮ হাজার ইউরোর মতন, মাসে মাসে এই একাউন্ট থেকে জার্মানিতে বসে ৬৭০ ইউরো তুলে নেওয়া যায়।
সব শহরে কি একই নিয়ম?
জার্মানিতে প্রতিটি স্টেট স্বাধীন এবং তারা নিজস্ব নিয়মের অধীনে চলে। যেহেতু ব্লক একাউন্টের নিয়ম কোন “আইন” নয়, বরং মূল আইনের (মূল আইন হল, জার্মানিতে পড়তে হলে ফাইন্যান্স দেখাতে হবে, এবং এর জন্য কয়েকটি পন্থা আছে। ব্লক একাউন্ট এর একটি পন্থা মাত্র।) একটি প্রয়োগ মাত্র, সেহেতু সব শহরের ব্যবস্থাপনাকে হুবহু একই ব্লক একাউন্ট চাইতে হবে এমন কোন কথা নেই। কিছু কিছু শহরে এখনও ব্লক একাউন্ট ছাড়াও ভিসা বাড়াতে দেয়া হয়। তবে দুঃখজনক হলেও সেই তালিকা আমি এখানে দিচ্ছি না।
কেন?
প্রথমত, বেশীরভাগ শহরেই এই নিয়ম চালু আছে, এবং প্রতিনিয়ত এই সংখ্যা বাড়ছে। কিছু শহর এখনও বাংলাদেশসহ অন্যান্য কিছু দেশের ভুয়া কাগজের প্রমাণ পায় নি, আর কিছু শহর আছে যাদের কর্মচারীরা জাস্ট “ভালো মানুষ”। এমনকি একই শহরের ফরেন অফিসে দুইজন কর্মচারীর একজন ব্লক একাউন্ট ছাড়া ভিসা দেয়নি, অথচ অন্য একজন দিয়েছে।
সুতরাং আমরা যদি আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দুই একটা শহরের নাম দেইও, তাহলে নিম্নের সমস্যাগুলো এড়ানো যাচ্ছে নাঃ
১। কোন গ্যারান্টি নেই যে, আগের জনকে ব্লক ছাড়া ভিসা দেওয়া হয়েছে বলে পরের জনও পাবে।
২। একজন কর্মচারী ভাল হলেই পরের বার অন্যজনও হবে, এই নিশ্চয়তা নেই।
৩। সবাই যদি শুধু ব্লক একাউন্টের কারণে অপছন্দের বিষয় নিয়ে দুই একটি শহরেই পড়তে যায়, তাহলে তাদের আসল উদ্দেশ্য যে পড়া নয়, সেটা পরিষ্কার।
আমি জানি কিছু গ্রুপে কিছু ছেলেপেলে টিপস দিচ্ছে, জার্মানির কিছু শহরের নাম বলে, যেখানে ব্লক একাউন্ট ছাড়াও ভিসা পাওয়া যায় বলে। শুধু একটা কথাই বলতে চাই, জার্মানদের সাথে আমাদের মূল পার্থক্য হল, আমরা খুব অল্প সময়ের চিন্তা করে আমাদের প্ল্যান করি। একটু লম্বা সময়ের কথা চিন্তা করে কাজ করি না বলেই আমাদের এত সমস্যা।
উপসংহারঃ
জার্মানিতে পড়তে আসতে চাইলে ব্লক একাউন্টের এক বছরের টাকা যোগাড় করে আনাই বুদ্ধিমানের কাজ। যদি টাকা তুলে ফেলা যায়, তাহলে তো ভালই। কিন্তু তুলে ফেলা যাবেই, এমন কথাকে নিশ্চয়তা হিসেবে নিয়ে প্ল্যান করে পরে বড় রকমের পস্তানোর কোন মানে নেই। আমি জানি ব্লক একাউন্টের নিয়ম খুব কঠিন একটা নিয়ম। নিজেও এত টাকা ম্যানেজ করে জার্মানিতে আসতে পারতাম না। কিন্তু এই অবস্থার জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। শুধু নিজের কথা ভেবে, বেশি শর্টকাট খুঁজতে গিয়ে পরবর্তীতে বাংলাদেশের জন্য একেবারেই ভিসা যেন বন্ধ না হয়ে যায়, সেই কথাটাও সবাইকে মাথায় রাখতে হবে।
যারা আপনাদের ফেসবুকে আমাদের সাইটের প্রতিটি লেখা পেতে চান তারা এখানে ক্লিক করে আমাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে গিয়ে লাইক দিয়ে রাখতে পারেন।তাহলে আমিওপারিতে প্রকাশিত প্রতিটি লেখা আপনার ফেসবুক নিউজ ফিডে পেয়ে যাবেন। ধন্যবাদ।