“লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক।” হজের এই মূলমন্ত্রে আবার মুখরিত হয়ে উঠেছে মক্কার অদূরে অবস্থিত বিশাল আরাফাতের ময়দান। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল ভেদাভেদ ভুলে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে কাফন সদৃশ্য সাদা কাপড় পড়ে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও লক্ষ লক্ষ মুসলিম বান্দা পবিত্র হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় হাজির হচ্ছেন।
স্বভাবতই আমাদের অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে হজ্জ কি? হজ্জের উদ্দেশ্য কি? হজ্জের গুরুত্ব ও তাৎপর্য কি? এবং এর নিয়ম কানুন কি? আমরা এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে সংক্ষেপে হজ্জ সম্পর্কে আলোচনা করার চেষ্টা করব।
হজ্জের আভিধানিক অর্থ যাত্রা করা বা তীর্থ যাত্রা করা বা উচ্চ মর্যাদার সমাসীন হওয়ার যাত্রা। কিন্তূ, ইসলামের পরিভাষায় সকল প্রকার প্রলোভন, কপতটা, অহংকার ও ঈর্ষা ত্যাগ করে, একটি পরিশুদ্ধ আত্মা নিয়ে ৯ জিলহাজ্জ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাই হজ্জ। এর মাধ্যমে পরম পবিত্রতা অর্জন ও আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব।
হজ্জ হচ্ছে ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ। এর অন্যতম উদ্দেশ্য হল মৃত্যু, শেষ বিচারের দিন, ও আল্লাহর সাক্ষাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া। কোরআন ও হাদিসের আলোকে হজ্জের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য হজ্জ ফরজ। এ প্রবন্ধে বুখারী ও মুসলিম শরীফে রয়েছে, “জান্নাত ছাড়া একটি গ্রহণযোগ্য হজের(মাবরুর) আর কোন পুরস্কার নেই”। এছাড়া নবী করিম (সাঃ) বলেছেন “যে হজ্জ পালন করেছে ও নিজেকে সকল লাম্পট্যতা, বাগ-বিতন্ডা ও অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখে সে নবজাতকের ন্যায় নিস্পাপ হয়ে ঘরে ফিরে।” (আল-বুখারী)। এছাড়া উম্মার জন্য আর্থিক ও আধ্যাত্মিক গুরুত্বও অসীম। এর মাধ্যমে সার্বজনীন মুসলিম ঐক্য, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্যবোধ সৃষ্টি হয়।
হজ্জ পালনের জন্য নিদিষ্ট ধর্মীয় আচার ও বিধি নিষেধ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-“হজ্জের মাসসমূহ সুপরিচিত। সে সময় যে হজ্জে যাবে (এজন্য ইহরাম বাঁধবে) সে যেন জেনে রাখে, হজ্জের সময় যৌন সম্ভোগ নেই, কোন অবাধ্যতা ও বিবাদ নেই। আর যত ভাল কাজ তোমারা করো আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তা জানেন।হজ্জের নিয়তকালে তোমরা পাথেয় জোগাড় করে নাও।যদিও তাকওয়াটাই (আল্লাহকে ভয়) সর্বোৎকৃষ্ট পাথেয়, অতএব হে বুদ্ধিমান মানুষেরা, তোমরা আমাকেই ভয় করো।” (২:১৯৭)
হজ্জের প্রকৃত প্রস্তুতি ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পর্কে জ্ঞান র্অজন করাই নয়।প্রাথমিক বিষয় হচ্ছে অন্তরের, যেটা আল্লাহর কাছে গ্রহনযোগ্য অবস্থায় সঙ্গে নিতে হবে।সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে হজ্জ ভ্রমনে আল্লাহর আনুগত্য সম্পন্ন একটি মন নিয়ে যাওয়া।সচেতন থাকা কেননা আল্লাহ সব সময় তোমাকে দেখছে এবং তোমার প্রয়োজনে সঙ্গে আছে।
ধর্মীয় আচারের চেয়ে অন্তরের অবস্থা বেশী গুরুত্বপূর্ণ।যদি বান্দার অন্তরের অবস্থা আল্লাহর নিকট গ্রহনযোগ্য হয় ধর্মীয় আচাঁরে ছোট খাটো ভুল হলওে আল্লাহ্ আমাদরে মাফ করে দিবেন কেননা তিনি দয়াশীল ও ক্ষমাশীল প্রভু ।কিন্তু অন্তর যদি শিরক (আল্লাহর অংশীদার বানানো) ও অহমিকা দ্বারা পূর্ণ থাকে তাহলে ধর্মীয় সকল অনুষ্ঠানাদি সঠিকভাবে পালন করলেও হজ্জের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে।
হজ্জ পালনের জন্য হাজিরা একই সারিতে সমবেত হয়।মক্কা থেকে ইহরাম পরিহিত হাজিরা তালবিয়া পাঠ করতে করতে মিনায়, তারপর মিনা থেকে আরাফাতের ময়দানে হাজির হয়। কাবাতুল্লাহ চতুর্দিকে চক্কর মারে, মুলতাজামকে জড়িয়ে ধরে, কখনো আসওয়াদকে (কালো পাথর) চুম্বন করে, কখনো সাফা-মারওয়ার মাঝে ছোটাছুটি করে, কখনো জামারতে পাথর নিক্ষেপ করে। আরাফার ময়দানে সারাদিন থেকে সূর্য ডুবার সাথে সাথে মুজদালীফার ময়দানে খোলা আকাশের নিচে আসে। মুখে উচ্চারিত হতে থাকে-হে প্রভু, হে আমার রব। তোমার সম্মুখে আমি উপস্থিত-তুমিই একমাত্র রব। তোমার কোন অংশীদার নেই।
হজ্জই একমাত্র ইবাদত যা পালনের জন্য হাজিরা দুনিয়ার মায়া-মহব্বত, পার্থিব সব ধনসম্পদ, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা ছেড়ে একমাত্র আল্লাহর সন্তোষটি অর্জনের উদ্দেশ্যে বায়তুল্লাহ শরিফে পাড়ি জমান। হজ্জ মুসলমানদের মনে আনুগত্যের স্বীকৃতি, হৃদয়ের পবিত্রতা, ঈমানের শক্তি বৃদ্ধি ও আধ্যাত্মিক জীবনের চরম উন্নতি সাধনের দ্বারা অন্তরে পারলৌকিক সুখের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে।