ব্রাজিল থেকে এম শামীম আহসান যাচ্ছেন সুইজারল্যান্ডে তাঁর নতুন ঠিকানায়। প্রায় শেষ হতে চলা ঈদের ছুটির পরপরই উক্ত ৩ সিনিয়র কূটনীতিক যাঁর যাঁর নয়া কর্মস্থলে যোগ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ‘ত্রিভুজ বদলি’র এই সংবাদ দেশ-বিদেশের অধিকাংশ সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে গুরুত্বের সাথে। তবে ‘বিলেত টু ব্রাজিল’ রুটের যাত্রী হাইকমিশনার মিজারুল কায়েসকে ঘিরে কতিপয় সংবাদ মাধ্যমে তথ্যবিভ্রাট তথা বিদ্বেষমূলক প্রোপাগান্ডার প্রেক্ষিতেই আজকের এই মন্তব্য প্রতিবেদনের সূত্রপাত।
রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় করে লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অস্বচ্ছতা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগের প্রেক্ষিতেই নাকি মিজারুল কায়েসকে লন্ডন থেকে সরিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ লন্ডন সফরের সময় হাইকমিশনার মিজারুল কায়েসের কোন ক্রেডিবিলিটি কোথাও ছিল না এমনকি হোটেল স্যুটে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এবং প্রবাসী ব্যবসায়ীদের সামনেই নাকি প্রধানমন্ত্রী ভর্তসনা করেছেন হাইকমিশনার কায়েসকে, এমন সংবাদ প্রচারেরও ধৃষ্ঠতা দেখিয়েছে স্বার্থান্বেষী একটি মহল।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিবকে যুক্তরাজ্য থেকে ব্রাজিলে বদলির পেছনের আসল রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধানে এই প্রতিবেদকের কাছে এসেছে এমন সব তথ্য, যাতে মূলতঃ হাইকমিশনার মিজারুল কায়েসের প্রতি সরকারের সন্তুষ্টি ও আস্থার চিত্রই ফুটে উঠেছে। প্রোপাগান্ডার বিপরীতে বাস্তবতা আজ দিনের আলোর মতো এতোটাই পরিষ্কার যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ লন্ডন সফরের সময় মিজারুল কায়েসের ক্রেডিবিলিটি বহাল তবিয়তে ছিল বিধায় স্বার্থান্বেষী মহলের উদ্দেশ্যমূলক ও ভিত্তিহীন নালিশনামায় কর্ণপাত করেননি পররাষ্ট্র দফতরের নীতিনির্ধারক মহল।
সরকার কর্তৃক দূরদর্শীতার পরিচয়ের পাশাপাশি সময়ের সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার ফলশ্রুতিতেই হাইকমিশনার মিজারুল কায়েস বদলি হয়েছেন ব্রাজিলে। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অস্বচ্ছতা ও ক্ষমতার অপব্যবহারই যদি মিজারুল কায়েস করে থাকতেন, তবে তাঁর পরিণতি লেবাননের গওসোল আযম সরকারের মতোই হতো, এমনটা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সিনিয়র কূটনীতিক। এটাও সত্য যে, ভিত্তিহীন অভিযোগনামার স্বপক্ষে সরকারের কাছে কোন তথ্যপ্রমাণ থাকলে মিজারুল কায়েসের ডেস্টিনেশন ব্রাজিলের পরিবর্তে ঢাকা নির্ধারিত হতেও বিলম্ব করা হতো না।
আশাব্যঞ্জক বিষয় হচ্ছে, বর্তমান সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর ‘ইকোনমিক ডিপ্লোম্যাসি’র মূলমন্ত্রে ‘এক্সপোর্ট বাস্কেট’ সম্প্রসারণ নীতিমালাকে সফল করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দিনকে দিন সফলতাও আসছে। তারই অংশ হিসেবে ল্যাটিন আমেরিকার রাজধানী ব্রাজিলে সাম্প্রতিককালে প্রতিষ্ঠিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ দূতাবাসের বিশাল দায়িত্ব পালনে মিজারুল কায়েসকেই এই মুহূর্তে সবচাইতে ‘স্কিল্ড ডিপ্লোম্যাট’ হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ সরকার, বিশ্বস্ত কূটনীতিক সূত্র তেমন ইঙ্গিতই দিয়েছে এই প্রতিবেদককে।
৩ বছর আগে পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে মিজারুল কায়েসের নেতৃত্বেই বাংলাদেশ সরকারের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল ল্যাটিন আমেরিকার ৮ টি গুরুত্বপূর্ণ দেশ সফর করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি ঢাকার বানিজ্য, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিনিধিদলটির ঐ ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন’-এর সফলতার প্রেক্ষিতেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে ল্যাটিন আমেরিকার প্রথম দু’টি বাংলাদেশ দূতাবাস প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রাজিল ও মেক্সিকোতে।
ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনে মিজারুল কায়েসের নেতৃত্বাধীন বিশেষ টিম তখন ব্রাজিল-মেক্সিকো ছাড়াও আর্জেন্টিনা, চিলি, পেরু, কলম্বিয়া, পানামা ও জ্যামাইকা সফর করে। সফল ফলপ্রসু হবার প্রেক্ষিতে ব্রাসিলিয়াতে দু’বছর আগে বাংলাদেশ দূতাবাস প্রতিষ্ঠিত হয় ঠিকই, কিন্তু নানাবিধ জটিলতায় প্রথম নয় মাস দূতাবাসের কাজ চালাতে হয় রাজধানীর একটি হোটেল কক্ষ থেকে। দক্ষিণ আমেরিকার অর্থনৈতিক পরাশক্তি এই বিশাল দেশ ব্রাজিলে দূতাবাসকে ঢেলে সাজাতেই পার হয় এক বছরের বেশি সময়। থেকে যায় লোকবলের স্বল্পতা।
রাষ্ট্রদূত এম শামীম আহসানের সাথে সেকেন্ড সেক্রেটারি আলাউদ্দিন ভূঁইয়া, এই দুই অফিসার দিয়েই কোনমতে পার হয় দু’দু’টি বছর। ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট মিজারুল কায়েসের যোগদানের মধ্য দিয়ে ব্রাজিলের বাংলাদেশ দূতাবাস তথা দেশটিতে বাংলাদেশের মিলিয়ন ডলারের রফতানি বানিজ্যে নয়া গতি সঞ্চারের পাশাপাশি ল্যাটিন আমেরিকান প্রতিবেশী অন্যান্য দেশেও বাংলাদেশি রকমারী পন্যের নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি হবে, এমন আশাবাদ বিশ্লেষক মহলে। তাছাড়া আসছে দিনগুলোতে প্রতিবেশী বেশ ক’টি দেশের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বিষয়াদিরও দেখভাল করা হবে ব্রাসিলিয়াস্থ দূতাবাস থেকে, এমন আভাস সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
আরো আশাব্যঞ্জক বিষয়, অতি সম্প্রতি ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত ব্রিক্স সম্মেলনের সোনালী ফসল তথা সদ্য প্রতিষ্ঠিত ‘ব্রিক্স ব্যাংক’-এ বাংলাদেশের যোগ দেবার সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতেও ব্রাসিলিয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের গুরুত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না ও সাউথ আফ্রিকার সমন্বয়ে গড়া আন্তঃমহাদেশীয় অর্থনৈতিক ফোরাম (BRICS) ব্রিক্স-এর অন্যতম দেশ ব্রাজিলের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আকাশচুম্বি ‘প্রসপেক্ট’ সামলে নিতে মিজারুল কায়েসের মতো ঝানু কূটনীতিকের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাবার তাই এখনই সময়।
দেশটিতে চলতি বছর অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলকে ঘিরে বয়ে যায় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’-এর জোয়ার। বাংলাদেশি গার্মেন্টসের বিশাল বাজার ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে ব্রাজিলে। দু’বছর পরই আবার আসছে অলিম্পিক গেমসের আরেক মহাধুমধাম। দেশটিতে বর্তমানে ৪ হাজার বাংলাদেশির বসবাস, অদূর ভবিষ্যতে এই সংখ্যা ৪ লাখ হলেও অবাক হবার কিছুই থাকবে না। ইউরোপের অনেক দেশের বাংলাদেশিদের তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে ভালো আছেন ব্রাজিলে বসবাসরত বাংলাদেশিরা।
বানিজ্যিক রাজধানী সাও পাওলো ভিত্তিক ব্রাজিলীয় ও বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ‘ব্রাজিল-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরাম’-এর পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকারকে সাধুবাদ জানানো হয়েছে হাইপ্রোফাইল কূটনীতিক মিজারুল কায়েসকে ব্রাসিলিয়াতে নিয়োগ দেয়ার জন্য। নতুন রাষ্ট্রদূতকে স্বাগত জানাতে ব্যাপকভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে সংগঠনটি। সাও পাওলো চেম্বারও রাষ্ট্রদূত হিসেবে মিজারুল কায়েসের এই গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগকে দারুণ ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে।