মাঈনুল ইসলাম নাসিম : বিতর্কিত রাষ্ট্রদূত গওসোল আযম সরকার অবশেষে লেবানন ছেড়েছেন। বুধবার দুপুরের পর তার্কিশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে তুরস্কের উদ্দেশ্যে সস্ত্রীক বৈরুত ত্যাগ করেন তিনি। সেখানে ৩ দিন অবকাশ যাপনের পর ২৭ জুলাই রবিবার ভোর ৪ টায় তার্কিশের আরেক ফ্লাইটে ঢাকায় পৌঁছবেন গওসোল। লেবানিজ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২৪ ঘন্টার আল্টিমেটাম পাবার পর গওসোল চেয়েছিলেন পুরো একটি সপ্তাহ বৈরুতে অবস্থান করতে, কিন্তু প্রশাসনের ব্যাপক নজরদারি ও চাপের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন বাংলাদেশি এই কলংকিত কূটনীতিক।
দূতাবাস থেকে রাষ্ট্রদূত গওসোল আযমকে অপসারণের এক দিন আগেও লেবানন প্রবাসী হাজার হাজার বাংলাদেশি জিম্মি ছিল সংঘবদ্ধ দালাল সিন্ডিকেটের হাতে। গওসোল ও তার স্ত্রী সাদিয়ার সরাসরি সম্পৃক্ততা ও পৃষ্ঠপোষকতায় কালা সুমন ও ম্যাসেঞ্জার কিরনের নেতৃত্বাধীন অপরাধী এই চক্রটি দূতাবাসের ভেতরে-বাইরে এতোটাই বেপরোয়া ছিলো যে, তাদের প্রতিহত করা দূরে থাক, দালাল সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করার সাহস পায়নি বৈরুতের খেটে খাওয়া বাংলাদেশিরা। সুমন-কিরন গংয়ের হাতে নাজেহাল হবার ঝুঁকি তাড়িয়ে বেড়াতো জনগণকে।
সবসময় একটা ভয় কাজ করতো, না জানি দূতাবাসের স্যার-ম্যাডামরা মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে কখন কাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। গত ১ বছর ধরে গওসোল-সাদিয়া তাই করতেন সুমন-কিরনের সিন্ডিকেট টিকিয়ে রাখতে। বিবেকবর্জিত দায়িত্বহীন রাষ্ট্রদূত গওসোলের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং তার অর্থলিপ্সু ‘গডমাদার’ স্ত্রী সাদিয়ার প্রত্যক্ষ মদদে দালাল সর্দার কালা সুমন, ক্যাশিয়ার রব, ম্যাসেঞ্জার কিরন, পাসেপোর্ট জনি, হুক্কা দেলু, সাইদা জামাল, সাইদা জসিম ও বখাটে বাবুর শোষণ-নির্যাতন চোখ বুঁজে সইতে হয়েছে লেবানন প্রবাসী বাংলাদেশিদের।
কালা সুমন ও ম্যাসেঞ্জার কিরণের সহায়তায় দূতাবাসের ভেতরে গওেসোল-সাদিয়া ব্যস্ত থাকতো রীতিমতো ডিজিটাল ধান্ধায়। সুমন-কিরন তাদের ম্যাডামকে দিয়ে ফোন করাতো বিভিন্ন কোম্পানিতে এবং শ’দেড়েক লোক ঢাকা থেকে বৈরুত আনার মধ্য দিয়ে বিশাল অংকের লেনদেন ভাগাভাগিও হয় তাদের মাঝে। পাসপোর্ট বানিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতে দূতাবাসের গেটের বাইরে কফি শপে বসে থাকতো কালা সুমন আর ম্যাসঞ্জার কিরণ গেটে অবস্থানের পাশাপাশি ভেতরেও অবাধ যাতায়াতের মাধ্যমে ক্যাশিয়ার আবদুর রব হয়ে গওসোল-সাদিয়ার অপকর্মের যোগান দিতো।
কালো টাকার সব হিসেব নিকেশ যত্নের সাথে দেখভাল করতো ঢাকা থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত ক্যাশিয়ার রব। মাথায় টিউমার থাকলেও মৃত্যুর ভয় ছিলো না তার। বৈরুত থেকে রাষ্ট্রদূত গওসোল অপসারিত হলেও কালা সুমনের ঘনিষ্ট বন্ধু এই ক্যাশিয়ার রব এখনো দূতাবাসে বহাল তবিয়তে থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বৈরুতের কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ। দালাল সর্দার সুমন ভুইয়া ওরফে কালা সুমনের এই সেদিনও নুন আনতে পান্তা ফুরাতো বৈরুতে, কিন্তু গওসোল-সাদিয়ার কৃপায় আজ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ।
বাংলাদেশে নিজ এলাকা আখাউড়াতে ৩৫ লাখ টাকা দিয়ে সম্প্রতি জমি কিনেছে কালা সুমন। লাশের টাকা মেরে দিতে লেবাননে কালা সুমনের বহুদিনের সুনাম। ঢাকার বনানী বা শাজাহানপুর গোরস্থানের গোরখোদকরা যেমন চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকে কারো লাশ আসার জন্য, অপেক্ষায় থাকে মৃত্যু সংবাদের, ঠিক তেমনি লেবাননে কেউ মারা গেলে ঈদের আনন্দ অনুভব করতো কালা সুমন। মারা যাওয়া বাংলাদেশিদের লাশকে ঘিরে তার ছিল আরেক সিন্ডিকেট, যার মাধ্যমে লাশ দেশে প্রেরণের নামে চাঁদা উঠিয়ে আত্মসাৎ করতো এই নরাধম।
১৫ বছর আগে এই কালা সুমনের বাবা মোহাম্মদ হোসেন যখন বৈরুতেই অসুস্থতাজণিত কারণে মারা যান, তখন কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ তাঁদের পকেটের পয়সায় মরদেহ দেশে পাঠান। সিরিয়াতে আদম পাচারকারী হোসেন চৌধুরীর সাথেও এই কয়েক মাস আগে ভালো বানিজ্য ছিল কালা সুমনের। কালো টাকায় এতোটাই অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় কালা সুমন, নৈতিকতাকেও জাহান্নামে পাঠাতে পিছপা হয়নি লেবাননে। নিজের অভিনীতি ব্লু ফিল্ম তৈরী করে বৈরুতে ছাড়ে এই কুলাঙ্গার, যা স্থানীয় বাংলাদেশিদের অনেকেই দেখেছেন।
দেশে বউ থাকলেও লেবাননে গার্লফ্রেন্ডের অভাব নেই কালা সুমনের। বৈরুতে জেল খাটার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এই দালাল সর্দারের লিগ্যাল স্ট্যাটাস অনেক আগেই বাতিল হয়ে যায় রকমারি অপকর্মের পরিণতিতে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, গওসোল আযম ও তার স্ত্রী সাদিয়া তাদের গৃহকর্মী হিসেবে অফিসিয়াল জব কন্ট্রাক্ট দেখিয়ে বৈধ করে নেন লেবাননের ‘নাটের গুরু’ কালা সুমনকে। চাঁদপুরের কলংক শহিদুল ইসলাম কিরন নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে বহু বছর আগে আশ্রয় নেন ঢাকার মিরপুরে। বছর বিশেক পূর্বে চলে আসেন লেবাননে।
ব্ল্যাকমেইলিংয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী এই কিরন গত দুই দশক ধরে বৈরুতের সকল অপকর্মের মাস্টারমাইন্ড। তার মস্তিষ্ক থেকে নির্গত কূটকৌশলে সর্বনাশ হয়েছে বহু নিরীহ মানুষের। আপন ছোটভাই নয়নকে ভরা মজলিশে নিজ মায়ের জারজ সন্তান হিসেবে পরিচয় করাতে বিবেকে বাঁধেনি বৈরুতের এই নরাধমেরও। ৬০০ ডলার বেতনে কিরনকে ম্যাসেঞ্জার হিসেবে নিয়োগ দেয় গওসোল আযম সরকার। বৈরুতের বাংলাদেশ দূতাবাসকে ঘিরে করাপশনের পাইপলাইন রক্ষণাবেক্ষণে ম্যাসেঞ্জার কিরন সফলতা দেখিয়েছেন অভিজ্ঞতার আলোকে।
একসময় বাংলাদেশে সর্বহারা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততার পরিচয় দেয়া কিরনের কূটচালেই লেবানন আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে তিন ভাগ হয়ে যায়। রাষ্ট্রদূত গওসোল অপসারিত হবার স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই কুখ্যাত কিরনকে ম্যাসেঞ্জারের চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়েছে বৈরুতের বাংলাদেশ দূতাবাস। লেবাননে দালাল সিন্ডিকেট জগতের ‘হ্যান্ডসাম বয়’ বখাটে বাবু। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার এই যুবক বছর পাঁচেক হয় এসেছে লেবাননে। বিয়ার-গাঁজা-হুইস্কিতে ২৪ ঘন্টা নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা বখাটে বাবু শারীরিক গঠনকে কাজে লাগিয়ে কাছাকাছি চলে আসে কালা সুমনের। লিগ্যাল স্ট্যাটাস না থাকলেও বৈরুতের আরেক অবৈধ বাংলাদেশি মহিলার সাথে লিভ টুগেদার করছে বখাটে বাবু।
রাষ্ট্রদূত গওসোল আযম অপসারিত হবার পরপরই কালা সুমনের উপস্থিতিতে এই বখাটে বাবুর নেতৃত্বেই লাঞ্ছিত করা হয় বাংলাদেশ-বৈরুত এসোসিয়েশনের সাধারন সম্পাদক আবু করিমকে। প্রবাসী কল্যান সমিতির আহবায়ক মফিজুল ইসলাম বাবুকেও প্রাণনাশের হুমকি দেয় বখাটে বাবু, পাঠায় পিস্তল-রিভলবারের ছবি। কেরানীগঞ্জের ওবায়দুর রহমান জনি ওরফে পাসপোর্ট জনি, কেউ বলেন পিসি জনি। কালা সুমনের ঘনিষ্ট সহযোগী এই পাসপোর্ট জনি ঘরে বসেই পাসপোর্ট নবায়ন ছাড়াও যে কোন সিল দিয়ে দিতো যে কারো পাসপোর্টে। এমনকি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এ্যারাইভাল-ডিপার্চার সিলও বৈরুতে বসেই দিতো পাসপোর্ট জনি।
সিল-পাসপোর্টের ধান্ধা ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে মেয়েদের লেবাননে এনে প্রতারিত করার কারবারের সাথে সে জড়িত অনেক আগে থেকেই। বৈরুতে পাসপোর্ট জনির বাসাতেই জমজমাট আড্ডা দিয়ে থাকে মুখচেনা দালালরা। কালা সুমন গংয়ের আরেক সহযোগী কুমিল্লার দেবিদ্দারের দেলোয়ার হোসেন দেলু ওরফে হুক্কা দেলু। বৈরুতে হুক্কা টানায় তার খ্যাতি আছে। হুক্কা থাকে তার মোটর সাইকেলের ভেতরেই। রাজধানী বৈরুত থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরবর্তি বাংলাদেশি অধ্যুষিত ‘সাইদা’ নামক এলাকাতে সাম্প্রতিককালে উত্থান ঘটেছে নয়া দুই দালাল জামাল ও জসিমের।
সাইদাতে বসবাস করায় এদেরকে সাইদা জামাল ও সাইদা জসিম নামে সবাই চেনেন। প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশির বসবাস সাইদাতে। জামাল-জসিমের ব্যবস্থাপনায় কয়েক মাস আগে সাইদাতে ঢাকঢোল পিটিয়ে আয়োজন করা হয় দালালদের এক জমজমাট মিলন মেলা, যেখানে কালা সুমন গং সহ সস্ত্রীক যোগ দেন গওসোল আযম সরকার। কিন্ত কপালের লিখন যায় না খন্ডন।
গেল সপ্তায় হাটে হাড়ি ভেঙ্গে যাওয়ায় লেবানিজ সরকার কর্তৃক দেশ ছাড়ার আল্টিমেটাম পায় গওসোল। ঢাকার নোটিশও তার হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়। নড়েচড়ে বসে স্থানীয় প্রশাসন। একাধিক মামলা দায়ের হয়ে যায় সুমন-কিরন সহ অপরাপর প্রতারক-দালালদের বিরুদ্ধে। লেবানিজ গোয়েন্দা জালের ভেতরেই এখন সমাজবিরোধী এই চক্রটি। দায়ের করা মামলার আসামী হিসেবে ধরা পড়া এখন শুধুই সময়ের ব্যাপার।