গোলাম মোহাম্মদকে এমন এক সময় সুদূর ইন্দোনেশিয়া থেকে গ্রীসে নিয়োগ দেয়া হয় যখন এথেন্সের বাংলাদেশ দূতাবাস পরিণত হয়েছিল সংঘবদ্ধ দালাল-সিন্ডিকেট চক্রের জালিয়াতি আর লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে। দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ যোগসাজশে চিহ্নিত দালাল চক্র দূতাবাসের ভেতরে বাইরে গড়ে তোলে পাসপোর্ট পিসি, কেনা-বেচা, সার্টিফিকেট প্রদান সহ লক্ষ লক্ষ ইউরোর রমরমা বানিজ্য। ভয়াবহ দুর্নীতির আখড়া বাংলাদেশ দূতাবাসকে ঘিরে দিনকে দিন প্রবাসীদের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। খেটে খাওয়া নিরীহ প্রবাসীদের রীতিমতো জিম্মি করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে অনেকেই তখন হয়ে যান আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ।
বিশ্বের নানা প্রান্তে সমস্যার গোড়ায় হাত দেবার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সাহসী রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ গত বছর দায়িত্ব নিয়েই ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বন করলে শুরুতেই ভুক্তভোগীদের প্রশংসাভাজন হন, যদিও সিন্ডিকেট জগতে ঘটে ছন্দপতন। লক্ষ ইউরোর পাসপোর্ট বানিজ্যের ভাগ বাটোয়ারার অংশীদার দালাল-সিন্ডিকেট চক্রটি যথেষ্ট সময় নিয়ে রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদকে ম্যানেজ করার সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যায় দিন-রাত। বছর গড়িয়ে যায়, দালাল চক্র সুবিধে করে উঠতে না পারায় দূতাবাসের প্রতি ধীরে ধীরে আস্থা ফিরে আসে এথেন্সের হাজার হাজার বাংলাদেশির, হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন সবাই। একসময় যেখানে দূতাবাসের কোন সার্ভিস পেতে দালাল-সিন্ডিকেটের শরণাপন্ন হবার বিকল্প ছিলো না, সেখানে রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ দায়িত্ব নিয়েই দূতাবাসের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেন সবার জন্য। গ্রীসের বিভিন্ন কারাগারে আটক হতভাগ্য বাংলাদেশিদের পাশে দাঁড়ান তিনি শুরু থেকেই।
২০১৩ সালে এথেন্স থেকে ৩শ’ কিলোমিটার দূরে নেয়া মানোলাদা গ্রামে স্ট্রবেরি খামারে বকেয়া বেতনের দাবীতে আন্দোলনরত নিরীহ বাংলাদেশি শ্রমিকদের উপর খামার মালিক নিজ হাতে গুলি চালানোর পর আহত বাংলাদেশিদের গ্রীসে বৈধতা পাইয়ে দিতে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ। বাংলাদেশি শ্রমিকদের বৈধতা প্রদান অনুষ্ঠানে এই প্রতিবেদক সরেজমিনে উপস্থিত থেকে স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের কাছে তখনই নিশ্চিত হন তাঁর যুগান্তকারী ভূমিকার বিষয়টি। গ্রীক মিডিয়াও বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সফলতার কথা ফলাও করে প্রচার করে তখন।
প্রভাবশালী দালাল চক্রের বিরাগভাজন হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারন জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ রীতিমতো প্রবল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন গ্রীস প্রবাসী ২৫ হাজার বাংলাদেশির কাছে। প্রলোভন-তোষামোদী কোন কিছুতেই কাজ না হওয়ায় দালাল-সিন্ডিকেট চক্রের মাঝে হতাশার পাশাপাশি বাড়তে থাকে ক্ষোভ, শুরু হয় ষড়যন্ত্র। রাতভর গোপন বৈঠক চলে এথেন্সের আনাচে-কানাচে, যে করেই হোক গোলাম মোহাম্মদকে ফাঁসাতে হবে, বিদায় করতে হবে গ্রীস থেকে। কুচক্রিদের যেমন পরিকল্পনা তেমন কাজ। বিভিন্ন সময়ে নানান অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূতের দেয়া বক্তব্য এবং ব্যক্তিগত আলাপচারিতার একাধিক অডিও ক্লিপকে চক্রান্তকারীরা মাস্টার এডিটিংয়ের মাধ্যমে চরিত্র হরণমূলক এমন কিছু তৈরী করে ইদানিং সোশ্যাল মিডিয়াতে এমনকি ঢাকার পররাষ্ট্র দফতরসহ যত্রতত্র পাঠিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে, এই প্রতিবেদককে এমনটাই জানালেন রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ। স্বাধীনতার মাসের প্রথম দিবসে খুব আক্ষেপ করেই তিনি বললেন, একজন মুক্তিযোদ্ধার যেমন দেয়ালে পিঠ ঠেকে থাকে না, তিনিও এর ব্যতিক্রম নন। এথেন্সে এসেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের মুখ উজ্জ্বল করেন তিনি।
কথার সাথে কাজের মিল রেখে, নীতির প্রশ্নে আপোষহীন থেকে এথেন্সের বাংলাদেশ দূতাবাসকে কলংকমুক্ত করতে এক কথায় সফল হয়েছেন রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ। তাঁর দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় বাংলাদেশ কমিউনিটির তরফ থেকে অকৃপন সহযোগিতা করতে যারা পিছপা হননি, তারা সহ সকল প্রবাসীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, দেশে-দেশে কমিউনিটির কল্যানে তথা প্রবাসী বাংলাদেশিদের সমস্যার গভীরে হাত দেয়াটা মূলত তাঁর বিবেকের দায়বদ্ধতা এবং একারণে বিভিন্ন দেশে একাধিকবার তাঁকে বিব্রত হতে হয়েছে। দুবাইতে কনসাল জেনারেল এবং আম্মানে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে সমাজবিরোধী চক্রান্তকারীদের গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয় তাঁকে। এতে একাধিকবার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অন্যায়ের কাছে কখনোই মাথা নত করেননি রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদ।
এথেন্স থেকে সাম্প্রতিককালের প্রোপাগান্ডা একদিকে রাষ্ট্রদূত গোলাম মোহাম্মদকে সাধারন প্রবাসীদের কাছে যেমন আরো মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে, অন্যদিকে দালাল-সিন্ডিকেট চক্রের প্রতি ভুক্তভোগীদের ঘৃণা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ দূতাবাস আবার জিম্মি হোক দালাল-সিন্ডিকেট চক্রের হাতে, দূতাবাস আবার হয়ে উঠুক দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য, তা কোনভাবেই আজ কাম্য নয় গ্রীসের হাজার হাজার বাংলাদেশির।