মাঈনুল ইসলাম নাসিম : ‘গরু মেরে জুতা দান’ না ‘জুতা মেরে গরু দান’ – বাংলা ব্যকরণে দুটোর ব্যাখ্যাই দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আমিরাত সফর এবং দেশটির শ্রমবাজারে আমাদের তালাবদ্ধ দুয়ারের ‘চাবি’ হারিকেন দিয়ে খুঁজতে গিয়ে বারবার আজ সামনে আসছে ‘জুতা মেরে গরু দান’-এর বিষয়টি। অপ্রিয় হলেও কঠিন সত্যের মুখোমুখি আজ আমরা। বৈশ্বিক বানিজ্যিক প্রদর্শনী ‘ওয়ার্ল্ড এক্সপো-২০২০’ এর ভেনু নির্বাচনে গত বছর ভোটাভুটির প্রথম পর্বে দুবাইকে ভোট না দিয়ে কী সর্বনাশই না আমরা করেছিলাম।
রেমিটেন্স ও শ্রমবাজারের কথা বেমালুম ভুলে তখন আমরা রাশিয়াকে খুশি করতে ব্যতিব্যস্ত হলাম নিউক্লিয়ার চুক্তির প্রতিদান দিতে। রাশিয়া পেল আমাদের ‘নিস্ফল’ ভোট। হাস্যকর হলেও সত্য, প্রথম পর্বের ভোটাভুটির পরপরই যখন আমরা নিশ্চিত হলাম এক্সপো-২০২০ রাশিয়া নয় বরং দুবাই’র দরজাতেই কড়া নাড়ছে, তখন নেক্কারজনকভাবে ভোল পাল্টে ফেললাম আমরা। ‘সুযোগসন্ধানী’র মহাচরিত্রে অভিনয় করে পরবর্তী পর্বে আমরা ভোট দিলাম দুবাইকে, কিন্তু কুল রক্ষা হয়নি কিছুতেই। ভোটাভুটির প্রথম পর্বে ‘জুতা মেরে’ পরে গরু-মহিষ কোন কিছুর দানেই সন্তুষ্ট হয়নি আমিরাতের রাজা বাদশাহরা।
বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে প্রায় ১৩ লাখ বাংলাদেশি অধ্যুষিত এই দেশটিতে এমনিতেই আমাদের স্বদেশি ভাইয়েরা দেশী স্টাইলে আকাম-কুকাম করে ভাবমূর্তির বারোটা বাজিয়ে আসছিলেন, তার মধ্যে যোগ হয় এক্সপো ইস্যুতে রাষ্ট্রীয় মোড়কে ‘জুতা মেরে গরু দান’-এর উপহাস। আবুধাবি দুবাই শারজাহ আল-আইন সহ দেশটির বিভিন্ন জনপদের স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট বিশ্বস্ত সূত্রগুলো এই প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছে, আমিরাত সরকার মনেপ্রাণে আন্তরিকভাবে শুরু থেকেই আশা করেছিল এক্সপোতে আমাদের মূল্যবান ভোট এবং এর বিনিময়ে তারা আবারো কর্মী নেয়ার প্রক্রিয়া জোরেশোরে শুরু করতে প্রস্তুতও ছিল।
সবাইকে হতাশ করার মধ্য দিয়ে আমরা যখন দুবাইকে ভোট না দিয়ে রাশিয়াকে ভোট দিলাম, এর মধ্য দিয়েই মূলতঃ হারিয়ে যায় শ্রমবাজারের তালাবদ্ধ দুয়ারের চাবি। ঢাকার কূটনৈতিক আনাড়িপনার তখন এখানেই শেষ নয়। দুবাইকে ভোট না দিয়ে রাশিয়াকে ভোট দেবার আগাম ঘোষণা আমরা যখন অফিসিয়ালি চিঠি দিয়ে তথা ঢাকঢোল পিটিয়ে জানান দিলাম সারা দুনিয়াতে, তখন চরম ক্ষুব্ধ হয় আমিরাত প্রশাসন। দুর্ভাগ্য আমাদের, সেগুনবাগিচার কূটনৈতিক অদূরদর্শীতায় আরবের মরুপ্রান্তরে মরিচীকায় মিশে যায় শ্রমবাজার খোলার সব সম্ভাবনা। ফলশ্রুতিতে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে যা হবার তাই হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।
আমিরাত সরকারের তরফ থেকে তেমন কোন কূটনৈতিক প্রতিশ্রুতি না থাকা সত্বেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী অতি সম্প্রতি দেশটি সফরে গেলেন। দুই দেশের মধ্যে বানিজ্য, জনশক্তি ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত ৬টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে – এমনটা ফলাও করে প্রচার করার পাশাপাশি ‘প্রত্যাশার পারদ’ উপচে পড়ার কথা বারবার বলা হলেও সফরের ফলাফল এখন সবারই জানা। রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরানকে সাধুবাদ জানাতে হয় এজন্য যে, এক্সপো ইস্যুতে ‘পাথর হয়ে যাওয়া বরফ’ গলাতে ‘এটলিস্ট’ তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর একটি আনুষ্ঠানিক সফর করাতে পেরেছেন।
বিশ্বস্ত সূত্র আরো জানাচ্ছে, আমিরাত সরকার আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলেই আলোর মুখ দেখেছে প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় সফর, নয়তো এটাও ঝুলে যেতো। ‘জুতা মেরে গরু দান’ হিতে বিপরীত হবার পর সঙ্গত কারনেই আরবের রাজা-বাদশাহদেরকে সন্তুষ্ট করতে আসলেই এখন আমাদের দেওয়ার পালা। কিছু না পেলেও প্রধানমন্ত্রীর সফরে তাইতো শুধু দিয়েছি আমরা। মরুপ্রান্তরে আকাম-কুকাম করা দেশী ভাইদেরকে আমরা নাজিম উদ্দিন রোড বা কাশিমপুরে নিয়ে আসবো পাশাপাশি ঢাকায় জমি বরাদ্দ দেবো আমিরাতের দূতাবাসের জন্য – এমন চুক্তিইতো আমরা করে এলাম। মন্দের ভালো এমনই হয়। তারপরও আমরা হতাশ নই। এক্সপো’র ক্ষত সেরে উঠতে সময় লাগছে, আরো লাগবে।