আমরা অনেকে মানতেই চাইনা আমাদের শরীরে অধিকাংশ রোগের সৃষ্টি হয় মানুসিক সমস্যা থেকে। অনেকের ধারণা মানুসিক সমস্যা মানে পাগল-টাগল হয়ে যাওয়া। এই ধারনাটা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করেছে মনোবিজ্ঞান। মনের প্রভাব থেকেই শরীরে প্রভাব পড়ে। যার ফলে আমরা বিভিন্ন শারিরিক সমস্যায় ভুগি।জ্বর,মাথা ব্যথা, মাংসপেশীতে ব্যাথা, ক্যান্সার, টিউমার, মানুসিক ভারসাম্যহীনতা, মোটা হয়ে যাওয়া, ত্বকে ব্রন উঠা, অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দা, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, অহেতুক ভয় পাওয়া, বিষন্নতা, জৈবিক চাহিদা কমে যাওয়া, বিচ্ছেদ, আত্মহত্যা ইত্যাদি সমস্যাগুলোর উৎপত্তি স্থল মূলত মন। মন খারাপ ভালোর প্রভাবে শরীরে বিভিন্ন রোগের জন্ম বা ধ্বংশ হয়। যেমন অনাদি রহমান একটা সমস্যায় অনেকদিন যাবৎ ভুগছিলেন। তার সমস্যা ছিল ঘাড়ে ব্যাথা। যার বিস্তৃতি ঘটে মেরুদন্ড বেয়ে কোমর অবধি। তিনি ডাক্তারের কাছে যান। ডাক্তার অনাদি কে অনেক টেস্ট করান। টেস্টের রিপোর্টে বিশেষ কোনো সমস্যা পাওয়া যায়নি। সমস্যা ছাড়া ডাক্তার অনাদিকে ঔষধ দিতে নারাজ। অপর দিকে ব্যথাও অনাদির পাছ ছাড়ে না। ডাক্তার তাকে পরামর্শ দেন একজন ফিজিওথ্রারাপিস্টের সরনাপন্ন হতে। থেরাপিস্ট জানতে চান অনাদি কি কাজ করেন? জন্ম কোথায়? বাবা মা কি করেন? বন্ধু বান্ধবী ক’জন ইত্যাদি? অনাদি অহেতুক প্রশ্ন পছন্দ করেন না। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে চলে আসেন তিনি। অনাদি মূলত রাত জেগে কাজ করেন। প্রায় সারা রাত জেগে থাকেন তিনি। তার প্রিয়জনরাও কাছে থাকেন না। কাজের প্রায় পুরোভাগ সময়টা চেয়ারে বসে কাজ করেন অনাদি। দিনের শুভ্র আলোয় তিনি হয়ত ঠিকমত ঘুমাতেও পারেননা। এসব কারনে তার মনের উপর একটা চাপ থাকে প্রায় সব সময়। আর মানষিক এই চাপ থেকেই মূলত অনাদি তার ঘাড়ে ব্যথাসহ বিভিন্ন শারিরিক সমস্যা অনুভব করেন। ঘুম কম হওয়ার কারনে প্রায় সব সময় খিটখিটে মেজাজে থাকেন। ডক্টর লুৎফুন্নেসা বেগম তার আধুনিক মনোবিজ্ঞান বইয়ে লিখেন সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমান নিদ্রার প্রোয়জন। নিদ্রার চহিদা সকল ব্যাক্তির মধ্যে সমান নয়। ব্যাক্তিতে ব্যাক্তিতে চাহিদার ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। তবে অধিকাংশ ব্যাক্তির দিনে ৬ থেকে ৯ ঘন্টা নিদ্রার প্রয়োজন হয়।
দীর্ঘদিন নিদ্রা বা ঘুম না হলে কি হয়?
ঘুম আমাদের স্নায়ু জনিত ক্ষয়কে রোধ করে। জীবনকে সজীব করে। ঘুমের অভাবে মেজাজ খিটমিটে হয়। শরীর ম্যাজম্যাজ করে। অল্পতেই রাগের সৃষ্টি হয় ও স্বাস্থ্যহানি ঘটে। একনাগারে কয়েকদিন পরিমিত ঘুম না হলে বিশেষ করে বহুমুত্র, রক্তচাপ ও হৃদরোগ বাড়তে পারে। শারীরিক ও মানুসিক অবসাদ দেখা দেয়। দীর্ঘদিন ধরে এমন চলতে থাকলে মানুসিক বৈকল্য পর্যন্ত দেখা দিতে পারে। না ঘুমিয়ে পশু কতো দিন বাঁচতে পারে এমন উপর পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বেশীর ভাগ পশুর মৃত্যু হয়েছে।
ঘুমের স্তর: ইলেকট্রো এনসেফালোগ্রামের সাহায্যে ঘুম সংক্রান্ত অনেক তথ্য জানাযায়। ঘুমের স্তরকে দুইভাগে ভাগ করা যায়- ক) রেম ঘুম। খ) নন-রেম ঘুম।
রেম ঘুম: মোট ঘুমের শতকরা ২৫ ভাগ হলো রেম ঘুম। এই ঘুমের চোখে তারার সন্চালন বিভিন্ন রকম হয়। এই স্তরের বৈশিষ্ট্য গুলি নীচে বর্ণনা করা হল:
১। এই স্তরের স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র সক্রিয় থাকে। তাই ঘুমের মধ্যেও পুরুষদের লিঙ্গ দৃঢ় হয়ে এবং বীর্যপাত হয়।
২। শ্বাস-প্রশ্বাস, হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ প্রভৃতি নিয়মিত থাকেনা। উঠা-নামা করে। অর্থাৎ কখনো কমে আবার কখনো বাড়ে।
৩। ঘুম হালকা থাকে।
৪। পেশী অতিমাত্রায় শিথিল থাকে।
৫। মানুষ এই স্তরে স্বপ্ন দেখে কিন্তু মনে রাখতে পারেনা।
নন-রেম ঘুম: ঘুমের শতকরা ৭৫ ভাগই নন-রেম ঘুম। এই ঘুমের বৈশিষ্ট্যসমূহ হলো-
১। শরীরের প্রধান প্রধান অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলির কৃয়া স্বাভাবিক থাকে।
২। শ্বাস প্রশ্বাসের হার কিছুটা ধীর গতিতে চলে।
৩। হৃদস্পন্দন ও নাড়ির স্পন্দন ধীর গতিতে সম্পন্ন হয়।
৪। রক্তচাপ ও শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা কম থাকে।
৫। পায়ের পাতা ও পা ঘন ঘন নড়াচড়া করে।
অনাদির ১ম সমস্যা অনিয়মিত নিদ্রা। ২য় সমস্যা প্রায় সারা রাত বসে থাকতে হয়। ৩য় সমস্যা প্রিয় মানুষদের ছেড়ে প্রবাসে থাকা। সব কিছু মিলিয়ে অনাদির উপর যে মানষিক চাপ থাকে তার ফলেই সে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা অনুভব করেন। কিন্তু অনাদি কোনো ভাবেই মানতে রাজি নন যে তার মনের প্রভাব শরীরে ভর করেছে। তিনি মনে করেন শরিরের সমস্যা মানে শারিরিক সমস্যা। এখানে মনের কোনো প্রাভাব নেই। অবশেষে থেরাপিস্ট তাকে দেশে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, প্রিয়মানুষদের সাথে কিছু সময় কাটাতে এবং নিয়মিত নিয়ম করে কিছু সময় ব্যায়াম করতে। ফিজিওথেরাপিস্ট অনাদিকে বুঝিয়ে বলেন গঠন বিন্যাসের দিক দিয়ে স্নায়ুতন্ত্রকে ২ ভাগে ভাগ করা যায়-
১। ঐচ্ছিক স্নায়ুতন্ত্র ও স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র।
ঐচ্ছিক কর্মসমূহকে নিয়ন্ত্রন করে এমন স্নায়ুগুচ্ছ কে বলা হয় ঐচ্ছিক স্নায়ুতন্ত্র। এসব স্নায়ু সাধারনত আমাদের মাংসপেশীর সাথে যুক্ত থাকে। আর স্বয়ংক্রিয় স্নায়ু সমূহ সাধারনত শ্বাসযন্ত্র, হৃৎপৃ-, পাচনতন্ত্র এবং অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিসমূহের কাজ করে। এক কথায়, স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র আমাদের দেহাভ্যন্তরীণ পরিবেশকে নিয়ন্ত্রন করে। সুতরাং আমাদের মাংসপেশীর অনেক সমস্যা আমরা চাইলেও কন্ট্রোল করতে পারিনা। তার জন্য দরকার পরিমিত ঘুম আর মানুসিক সুস্থতা। সাথে পরিমিত ব্যায়াম।
ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শে অনাদি তার নিজ দেশে গিয়েছিলেন এবং প্রিয় মানুষদের সাথে প্রায় মাস খানেক সময় কাটান। মজার বিষয় হলো অনাদি দেশ থেকে ফেরার পর তার শারিরিক সমস্যার প্রায় ৬০ ভাগ সুস্থতা অনুভব করেন। কারন অনাদি দেশে তার প্রিয় মানুষদের কাছে মানষিক চাপ মুক্ত সময় কাটিয়েছেন। আমরা যদি জানি আমাদের শরীর ও মন কিভাবে চালিত হয় তাহলে আমরা আমাদেরকে বুঝতে সক্ষম হব এবং ভালো থাকতে পারব।
আমাদের দেশে ফিজিওথেরাপিস্টদের তেমন মূল্যায়ন করা হয় না। অথচ বর্হিবির্শ্বে এর কত মূল্যায়ন। একজন ফিজিওথেরাপিস্টকে এখানে একজন ডাক্তার হিসেবেই মূল্যায়ণ করা হয়। কারন একজন ফিজিওথেরাপিস্ট হতে হলে ৫ বছর মেডিসিনের উপর পড়তে হয় এবং ১ বছর পড়তে হয় মনোবিজ্ঞান। আরো ২ বছর কোনো সিনিয়রের অধিনে প্রাকটিকেল করতে হয়। এখানে প্রথমেই কোনও রোগীকে ব্যাথা উপশমের ঔষধ দেয়া হয় না। রোগীর মানুসিক সমস্যা যাচাই করা হয়। অথচ আমার সোনার দেশে হরদম ব্যথা নাশক বা এন্টিবায়োটিক ওষধ দেয়া হয়। অনেক সময় ডাক্তারের পরামর্শেরও ধার ধারা হয় না। ফার্মাসী থেকে দেয়া হয় জটিল কঠিন রোগের ওষধ। যা এখানে অকল্পণীয়। বাংলাদেশে ডাক্তারখানা বা হাসপাতাল ক্লিনিক মানে ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান। সেখানে রোগীর কোনও পরীক্ষা নীরিক্ষা ছাড়াই ঘচাঘচ অপারেশন করা হয়। পরীক্ষা করা হলেও তার রিপোর্ট নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন আছে। কারন সেখানে পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য থাকে টাকা রোজগার করা, রোগীর রোগ নির্নয় করা নয়। যার কারনে প্রতি বছর বহু মানুষ শুধুমাত্র চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। এ ভাবে দেশের বহুটাকা বিদেশে চলে যায়। আর যাদের সামর্থ নেই তারা দেশের চিকিৎসা ব্যবসায়ীদের যাতাকলে পড়ে নিজের জীবনী শক্তি হারাতে বসেন। অর্থনৈতিক ভাবে সর্বশান্থ হন।
মন ও শরীর একে অন্যের সাথে জড়িত। যখন কারো মন ভালো না থাকে তখন তার শরীরও ভালো থাকেনা। আর যদি কারো শরীর ভালো না থাকে তাহলে তার মনও ভালো থাকেনা। মন ও শরীর একই সূত্রে গাথা। এসব বিষয়ে বিজ্ঞানীদের বহু তত্ত্ব আছে। আছে হাজারো তর্ক বিতর্ক। যেমন ফরাসি দার্শনিক ডেকার্ট জীব ও জড়ের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, জীবের সাধারণ ধর্ম হলো চেতনা আর জড়’র সাধারণ ধর্ম বিস্তৃতি। মানুষের দেহ হলো জড় পদার্থ ও অচেতন এবং মন বা আত্মা হলো সচেতন বা চেতনা। মন বা আত্মা বিহীন দেহের কোনো শক্তি নেই। এ কারনেই মানুষের মৃত্যুর পর দেহ অসাড়, নিথর হয়ে যায়। মিঃ ডেকোর্ট মনে করতেন মানুষের মধ্যে মন ও দেহ এই দুটি সত্তার সম্মিলন হয়েছে। তার এই মতবাদকে বলা হয় দেহ মনের দান্দিক মতবাদ। মানুষের মন অতীন্দ্রিয়, আর দেহ প্রাকৃতিক। মন হলো জ্ঞাতা। জ্ঞান হলো মানুষের মনে পুন্জীভূত কতগুলো ধারণার সমষ্টি। ডেকোর্ট বলেন, মনের কতগুলো ধারণা জন্মগত এবং ঈশ্বর প্রদত্ত। আর কতগুলো ধারণা সংবেদন থেকে আগত। ডেকোর্টের এই মতবাদের সর্বপ্রথম (১৬৩২-১৭০৪) প্রতিবাদ করেন দার্শনিক লক। মিঃ লক বলেন, মানুষের কোন ভাব বা ধারনা জন্মগত নয়। সমস্ত ধারনা বা জ্ঞান ইন্দ্রিয়ের সংবেদন থেকে আসে। অর্থাৎ জ্ঞান হলো অভিজ্ঞতালব্ধ আর অভিজ্ঞতার উৎস হলো সংবেদন। সুতরাং লক এর মতে জ্ঞানের উৎস হচ্ছে দেহানুভূতি। তবে মতোবাদ বা বিতর্ক যতোই থাক মিঃ লক বা অন্যান্য দার্শনিকরাও অতীন্দ্রিয় মন বা আত্মাকে অস্বীকার করতে পারেননি। প্রকান্তরে সবাই আত্মাকে স্বিকার করতে বাধ্য হয়েছেন।
Atma jinishta thake kothay?