**প্রকৃতি ও ঋতুর পরিবর্তনের সাথে এই পৃথিবীর সব কিছুরই পরিবর্তন হয়ে থাকে। গরমের ফল-মূল, শাক-সবজি, পোষাক-পরিচ্ছদ যেমন শীত ঋতুতে পাওয়া যায় না, তেমনি আবার শীতের জিনিস বর্ষায় পাওয়া যায় না—ইত্যাদি ইত্যাদি।
ঠিক তেমনি হৃদয় (Heart) নামক ইঞ্জিন চালিত রক্ত-মাংসে গড়া আমাদের এই দেহ নামক গাড়িটিরও রক্ষনাবেক্ষনের জন্য বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন জিনিস বা উপকরনের প্রয়োজন হয়। আমাদের এই দেহটি সম্পূর্নভাবে আবৃষ্ট আছে ত্বক দ্বারা। আর এই ত্বক আমাদেরকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করে চলেছে নানা রকম সমস্যা থেকে। তাই আমাদেরও উচিত যে, আমাদের এই ত্বককে সব সময় সুন্দর, পরিষ্কার, সজিব ও সতেজ করে রাখা।
যে তার ত্বককে সজিব ও সতেজ করে রাখে,- সে অবশ্যই রক্ষা পায় ত্বকের অনেক অনেক সমস্যা থেকে। গরমে ত্বক থেকে তেল বের হয় বেশী। এই তৈলাক্ত ত্বকের উপর বাহিরের ময়লা ও ধুলাবালি পড়ে ত্বকের লোমকুপ বন্ধ হয়ে যায় এবং ত্বকের সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। আবার সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি ত্বককে পুড়িয়ে দেয়। ব্রনের অত্যাচারও একারনে বেড়ে যায় অনেক বেশী।
গরমে যেমন ত্বক থেকে তেল বেড় হয়ে ত্বক তৈলাক্ত হয়। তেমনি আবার শীতে ত্বক হয় অতি শুষ্ক। আর এই অতি শুষ্কতার কারনে ত্বক যায় কুচকে। এই কুচকানো ত্বকের মাইক্রোস্কপিক ভাজের মধ্যে বাহিরের ধুলাবালি ও ময়লা পড়ে আটকে থাকে, এবং ত্বকের সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। ফলে আমাদের মুখসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কালো কালো ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায়।
গরম বা শীত ঋতুতে ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা ছাড়াও ঋতুর পরিবর্তনের সময়ে ত্বকের চরমভাবে সমস্যা হয়ে থাকে। ঋতুর পরিবর্তনের সময় আবহাওয়া, তাপমাত্রা এবং বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমান ভারসাম্যহীনতা অবস্থায় থাকে। আর এই তাপমাত্রা ও বাতাসে জলীয়বাস্পের তারতম্যের কারনে আমাদের ত্বকের সোহনশীলতার বা ভারসাম্যতার ব্যাঘাত ঘটে। এর ফলে ত্বকে এক ধরনের সংকোচন ও প্রসারনের সৃষ্টি হয়ে ত্বক ফেটে ফেটে যায়, ত্বক চুলকায় এবং ত্বকের সমস্যা বাড়িয়ে দেয়।
আরো একটি কারনে আমাদের ত্বকে বিভিন্ন সমস্যা বাড়িয়ে দেয়,- সেটা হলো ত্বকের মরা কোষ। জীবন মানেই মৃত্যু। আর তাই প্রতিনিয়ত আমাদের ত্বকে নতুন নতুন কোষ জন্ম নেয় এবং সেই সাথে ত্বকের কোষ মরে যায়। ত্বকে মরা কোষ যেন না জমে থাকে, সেদিকে লক্ষ্য রাখাটা ভীষন জরুরী। কারণ এই মরা কোষ ও ধুলাবালী, ময়লা একত্রে ত্বকে তিলেপড়া দাগ ও ব্ল্যাকহেড সহ ত্বকে নানা রকম সমস্যার জন্ম দেয়। এরকম নানাবিধ রকমের সমস্যা সত্যেও আমাদের শরীরের এই সুন্দর ত্বকটি নিজেই তার কোষগুলিকে রি-জেনারেট করে বিভিন্ন ঋতুর সাথে নিজেকে সোহনীয়মাত্রায় রেখে ভারসাম্যতা রক্ষা বা বিভিন্ন আবহাওয়ার সাথে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। আর তাই আমাদের উচিত, আমাদের এই ত্বককে সব সময় সুন্দর, পরিষ্কার, সজিব ও সতেজ করে রাখা ত্বকে এ ধরনের বিভিন্ন রকম সমস্যার প্রাকৃতিক সমাধান বা যত্নের জন্য আপনাদের লিখছি কিছু উপদেশের কথা বা টিপস। এখন আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে। গরম শেষে শীতের আগমনী বার্তা এসেছে। এই হালকা শীত এবং আবহাওয়ার পরিবর্তনে ত্বকের যত্নে আপনারা বেছে নিতে পারেন বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি তাজা ফলের পাশাপাশি সিজনাল কিছু সবজি।
লোমকুপের ময়লা : # তরমুজ বা পেসকা বা মেলনে বা পাকা পেঁপে, ব্লেন্ড করে কয়েক ফোঁটা মধু ও চালের বা আটার গুড়া মিশিয়ে স্ক্রাব (পেষ্ট) বানিয়ে নিন। ঘসে ঘসে পরিষ্কার করুন মুখের ত্বকসহ সারা শরীর। তারপর পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে ফেলুন। এতে লোমকূপের গোড়া থেকে বের হয়ে আসবে সারাদিনের জমে থাকা ধুলাবালি ও ময়লা। উপকার পাবেন আশা করি। উজ্জ্বলতাও বাড়বে ত্বকের।
# বিচি ফেলে তরমুজ বা পেসকা বা মেলনে বা পাকা পেঁপে, চটকে নিয়ে সারা মুখে ১০ মিনিট লাগিয়ে রাখুন। তারপর ঠাণ্ডা পানিতে ধুয়ে ফেলুন। এতে বাহিরের ময়লা দুর হবে। এটি ন্যাচারাল ফেস ওয়াসের কাজ করবে। ভালো ফল পাবেন।
রৌদ্রে পোড়া ত্বক : # গরমের সময়ে যারা (পুরুষ/মহিলা উভয়ই)বাহিরে বেশীক্ষন সময় থেকে কাজ করেছেন, তাদের ত্বকের ভীষন ক্ষতি হয়েছে। তাদের জন্যই এই বিশেষ টিপস। রৌদ্রে পোড়া ত্বকের জন্য চাই কিছু বিশেষ প্যাক। অনেক সময় রৌদ্র বা সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি পুড়িয়ে দেয় ত্বককে। রৌদ্রে নির্জীব হয়ে যাওয়া ত্বকে পাকা কলা, লেবুর রস ও মধুর মিশ্রণ ২০ মিনিট লাগিয়ে রাখুন। তারপর ধুয়ে ফেলুন। ভালো ফল পাবেন।
# দুধ ও কাচাঁ হলুদ বেটে মুখের ত্বকসহ সারা শরীরে মাখলেও ভালো ফল পাবেন আশা করি।
# রৌদ্রে পোড়া কালচে ভাব দূর করতে ছানার বা মোজ্জারেল্লার (Mozzarella) পানি, পাকা পেঁপে ও বেসন বা আটার গুড়া একসঙ্গে মিশিয়ে মুখের ত্বকে লাগান। ২০ মিনিট লাগিয়ে রাখুন। তারপর ধুয়ে ফেলুন। উপকার পাবেন আশা করি।
# রৌদ্রে পোড়ার দাগ দূর করতে তরমুজ ও পাকা পেঁপের জুড়ি নেই। তরমুজ বা পাকা পেঁপে অল্প চটকে ফ্রিজে রেখে দিন। রৌদ্রে পোড়া অংশে ভালো করে লাগান। ১৫ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন। নিয়মিত করলে দূর হয়ে যাবে রোদে পোড়া দাগ।
তৈলাক্ত ত্বক : # তৈলাক্ত ত্বকের জন্য শসার রসের সঙ্গে পেসকা বা মেলনে বা পাকা পেঁপে বা তরমুজের রস মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করুন। তারপর মুখে লাগিয়ে রাখুন ১৫ মিনিট। পরে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। উপকার পাবেন বেশ।
# পাকা পেঁপে ও আলুর রস একসঙ্গে মিশিয়ে মুখের ত্বকে লাগিয়ে রাখুন ২০ মিনিট। তারপর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। ভালো ফল পাবেন।
ব্রণ বা কালো দাগ : # ব্রণ ও মুখের কালো ছোপ ছোপ দাগ দূর করতে মাল্টার রসের সঙ্গে কাচাঁ হলুদের রস ও গুঁড়া দুধ মিশিয়ে লাগান। নিয়মিত ব্যবহারে উপকার পাবেন।
# ব্রণ দূর করতে নিমপাতার গুঁড়ার সঙ্গে শসার রস, গোলাপজল ও চন্দনের গুঁড়া একসঙ্গে মিশিয়ে প্যাক তৈরি করে ব্যবহার করুন। এতে ব্রণের দাগ থেকে অবশ্যই মুক্তি পাবেন, একথা বলতে পারি জোড় দিয়ে।
# কখনোই নোখ বা আঙ্গুল দিয়ে ব্রণ টিপবেন না বা খোঁচাবেন না। এতে করে ত্বকে কালো দাগ স্থায়ী হয়ে যায়।
ত্বকের মরা কোষ : # ফলের সঙ্গে বিভিন্ন সবজিকেও কাজে লাগাতে পারেন ত্বক সুস্থ রাখার জন্য। কচি লাউয়ের সাদা নরম অংশটি পিস পিস করে কেটে প্রতিদিন মুখের ত্বকে ঘষলে ত্বকের মরা কোষ উঠে যায়।
# শসা এবং আলু পিস পিস করে কেটে প্রতিদিন মুখের ত্বকে ঘষলেও ত্বকের মরা কোষ উঠে যায়।
# নরম খোঁসা বা স্পন্জের সাথে ভালো কোন ন্যাচারাল শ্যাম্পু বা সাবান মাখিয়ে মুখের ত্বক সহ সমস্ত শরীর ভালো করে আস্তে আস্তে ঘসে ঘসে গোসল করবেন। এতে করেও ত্বকের মরা কোষ উঠে যায়।
বলিরেখা ও মেসতার দাগ : # বলিরেখা ও মেছতার দাগ উঠাতেও একইভাবে লাউ পিস পিস করে কেটে হালকা গরম করে বলিরেখা ও মেসতার দাগের জায়গায় ঘষতে পারেন। উপকার পাবেন বেশ।
# জুক্কিনি বা শসা বা আলু পিস পিস করে কেটে একটু লেবুর রস মাখিয়ে প্রতিদিন মুখের ত্বকে ঘষলেও বলিরেখা ও মেছতার দাগ উঠে যায়।
ত্বকের রুক্ষতা : # পাকা কলা চটকিয়ে তার সঙ্গে লেবুর রস ও দুধ মিলিয়ে মুখ ও হাত-পায়ে লাগালে ত্বকের রুক্ষতা দূর হয়। পাশাপাশি ময়েশ্চারাইজারের কাজও হয়।
# তরমুজের রস ডিপ ফ্রিজে রেখে বরফ বানিয়ে মুখে ঘষতে পারেন। এতে রুক্ষতা কমে যেয়ে ত্বক সতেজ হবে।
# শসার রসের সঙ্গে সমপরিমাণ গোপালজল মিশিয়ে টোনার হিসেবে সমস্ত শরীরে ব্যবহার করা যায়। এতে ত্বক সতেজ হবে।
# পাকা পেঁপে, আলুর রস ও পাকা কলা মিশিয়ে মুখের ত্বকে ও সমস্ত শরীরে লাগিয়ে রাখুন ২০ মিনিট। তারপর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এতে ত্বক সতেজ হবে।
ত্বকের উজ্জ্বলতা : # ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে পাকা পেঁপে ব্লেন্ড করে কাঁচা হলুদের রস মিশিয়ে মুখের ত্বকসহ সারা শরীরে লাগিয়ে রাখুন। শুকিয়ে গেলে ঠাণ্ডা পানির ঝাপটায় ধুয়ে ফেলুন। উজ্জ্বলতা বাড়বে ত্বকের।
# টকদই ও টমেটোর রস মিশিয়ে মুখসহ শরীরের বিভিন অংশের ত্বকে লাগিয়ে রেখে ১৫-২০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন। এতে ত্বক উজ্জ্বল হবে।
# মসুরের ডাল, কমলার খোসা, দুধ ও কাচাঁ হলুদ একসাথে বেটে মুখের ত্বকসহ সারা শরীরে মাখলেও ভালো ফল পাবেন। ত্বক সজিব ও উজ্জ্বল রাখার জন্য ইন্ডিয়ান সুন্দরীরা প্রতিনিয়ত এই উপকরণটি ব্যাবহার করে থাকেন। এই উপকরণটি সপ্তাহে দুইবার আপনারা ব্যবহার করলে শতভাগ উপকার পাবেন, একথা আবশ্যই আপনাদের বলতে পারি।
এ ছাড়া এসময়ে মহিলারা যতটা সম্ভব মেকাপ এড়িয়ে চলবেন। মেকাপ নিতে হলে রাতে ঘুমানোর আগে আবশ্যই পরিষ্কার করে নিবেন। আর (পুরুষ/মহিলা উভয়ই)রাতে ঘুমানোর আগে তুলায় ঠাণ্ডা গোলাপজল নিয়ে ত্বক মুছে নিতে পারেন। এতে সারাদিনের ক্লান্তি দূর হবে।
ত্বকচর্চার পাশাপাশি খাদ্য তালিকাতেও প্রচুর পরিমাণ ভিটামিনসম তাজা ফল ও সবুজ শাকসবজি রাখা জরুরী। এই আবহাওয়াই ত্বক সজীব রাখতে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা আবশ্যক। ত্বকের লাবণ্যতা ধরে রাখতে প্রতিদিন কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা (6 hour) ঘুমানো প্রয়োজন।
আমি আপনাদের বলছি যে, “কালো ত্বক বা শ্যামলা ত্বক বা ফর্সা ত্বক,-এটা কোন বিষয় নয়”। পৃথিবীতে অনেকবারই বিশ্বসুন্দর বা বিশ্বসুন্দরী হয়েছেন কালো ত্বক বিশিষ্ট মানুষ। তাই সব সময়ই আপনারা (পুরুষ/মহিলা উভয়ই) মনে রাখবেন যে,- পরিষ্কার, সজিব ও সতেজ ত্বকই হলো কোমনীয়, মোহনীয় ও লাবণ্যময়ী ত্বক।
যারা আপনাদের ফেসবুকে আমাদের সাইটের প্রতিটি লেখা পেতে চান তারা এখানে ক্লিক করে আমাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে গিয়ে লাইক দিয়ে রাখতে পারেন।তাহলে আমিওপারিতে প্রকাশিত প্রতিটি লেখা আপনার ফেসবুক নিউজ ফিডে পেয়ে যাবেন। ধন্যবাদ।