মাঈনুল ইসলাম নাসিম : অর্থনীতির চালিকাশক্তি রেমিটেন্সের উৎস প্রবাসীদের স্বার্থরক্ষায় বাংলাদেশের কোন সরকারই আজ অবধি সর্বোচ্চ আন্তরিকতার পরিচয় দিতে পারেনি। সদ্যঘোষিত ‘জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা’ পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, বহুবিধ নিষেধাজ্ঞার বিধান রেখে সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রীসভার বৈঠকে অনুমোদিত নীতিমালায় ১ কোটি প্রবাসীদের অতীব গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সুনিশ্চিত করা সংক্রান্ত কোন বিধিমালা যেমন সংযুক্ত হয়নি, পাশাপাশি প্রবাসীদেরকে যত্রতত্র ফ্রি-স্টাইলে কটাক্ষ বা হেয় প্রতিপন্ন না করার বিধান সম্বলিত কোন নিষেধাজ্ঞাও আরোপিত হয়নি।
কেবিনেট কর্তৃক অনুমোদিত সম্প্রচার নীতিমালার পঞ্চম অধ্যায়ে সরকারী-বেসরকারী টিভি-রেডিও সহ যে কোন প্রচার মাধ্যমে কি কি বিষয় সম্প্রচার করা যাবে না এবং করা সমীচীন হবে না, তা সুনির্দিষ্টভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ঘোষিত নীতিমালায় মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খেটে খাওয়া প্রবাসীদের ন্যায্য অধিকার বিন্দুমাত্র রক্ষিত হয়নি, ফলশ্রুতিতে হতাশা ব্যক্ত করেছেন বিভিন্ন দেশের কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ।
শতাধিক দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা বছরের পর বছর ধরেই গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করে আসছেন মাতৃভূমির প্রচার মাধ্যম কর্তৃক তাঁদেরকে যথাযথ গুরুত্ব না দেয়ার বিষয়টি। অঘোষিত এই অবহেলার শিকার প্রবাসীরা যখন দূর প্রবাসে রক্ত পানি করে রেমিটেন্স প্রেরণের রেকর্ড গড়েন, তখন অবশ্য প্রচারমাধ্যমগুলো অনেকটা স্ববিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নিজস্ব কাটতি নিশ্চিত করতে রেমিটেন্স-নিউজ ফলাও করে প্রচার করতে কুন্ঠিত হয় না।
অথচ এই রেমিটেন্সের উৎস তথা জাতির ‘সোনার সন্তান’ প্রবাসীরা যখন আজো পায়নি তাঁদের জন্মগত ও সাংবিধানিক অধিকার তথা ভোটাধিকার, যখন মহান জাতীয় সংসদে প্রবাসীদের হয়ে কথা বলার মতো নেই কোন সাংসদ বা প্রতিনিধি, যখন ঢাকার বিমানবন্দরে প্রবাসীদের হয়রানি বন্ধে সরকার নির্বিকার, বিশ্বব্যাপী চিহ্নিত বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে নিরীহ প্রবাসীদের হয়রানি যখন থেমে নেই, তাদের পরিবার-পরিজন যখন দেশজুড়ে ভোগে নিরাপত্তাহীনতায়, প্রবাসীরা যখন দেশের কোন লেভেলেই পায় না ন্যূনতম কোন প্রায়োরিটি, প্রবাসীদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা যখন নিশ্চিত করতে পারে না সরকার, তখন এসব নিয়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রচার মাধ্যমেরই নিরব ভূমিকা বরাবরের মতো আজো প্রশ্নবোধক।
দেশের জনসংখ্যার ১৬ বা ১৭ ভাগের ১ ভাগ যদি প্রবাসী জনগোষ্ঠী হয়ে থাকেন, সেই অনুপাতে বাংলাদেশের সরকারী-বেসরকারী রেডিও-টিভি ও পত্র-পত্রিকা সহ যাবতীয় প্রচার মাধ্যমসমূহ কি তাদের ১৬ বা ১৭ ভাগ সময় বা স্পেস বরাদ্দ করতে পেরেছে ১ কোটি প্রবাসীর জন্য ? হলফ করেই বলে দেয়া যায়, পারেনি তারা, নিদারুন এই ব্যর্থতা বছরের পর বছর। মধ্যরাতের জনপ্রিয় টকশোতেও উচ্চারিত হয় না বললেই চলে প্রবাসীদের সুবিধা-অসুবিধার কথা।
সদ্য অনুমোদিত জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালায় অত্যন্ত যুগপোযোগী এই ইস্যুটি সরকার নিয়ে আসতে পারতো খুব সহজেই, প্রয়োজন ছিলো শুধু সদিচ্ছা আন্তরিকতা বিচক্ষণতা ও দায়িত্বশীলতার। কিন্তু হয়নি কাজের কাজ কিছুই। আরো উদ্বেগের বিষয়, ঘোষিত ও অনুমোদিত নীতিমালায় ‘‘যা প্রচার করা যাবে না’’ শীর্ষক তালিকায় রকমারী বহু বিষয়ের অবতারণা করা হলেও এরকম কিন্তু একটি বারের জন্যও বলা হয়নি যে, দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার কাজে নিয়োজিত প্রবাসীদের প্রতি যে কোন প্রচার মাধ্যমে কটাক্ষমূলক বা বিদ্রুপ করে কিছু প্রচার করা যাবে না, ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা যাবে না।
নাটক-সিনেমা যেহেতু জীবনেরই প্রতিচ্ছবি তাই সম্পূর্ণ অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে নাটকে বা সিনেমায় তথা যে কোন মিডিয়া প্রোডাকশনে যাচ্ছেতাইভাবে প্রবাসীদেরকে কেউ হেয় প্রতিপন্ন করলে তার শাস্তি কি হবে, তাও কিন্তু একেবারেই অনুপস্থিত মন্ত্রীসভায় অনুমোদিত জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালায়। উদাহরণ হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ের জঘন্য দুটি প্রোডাকশনের কথা এখানে না বললেই নয়। মোস্তফা কামাল রাজের রচিত ও পরিচালিত ধারাবাহিক ‘মাইক’ নাটকে হালের জনপ্রিয় অভিনেতা মোশারফ করিমের কমন ডায়ালগ ছিল ‘‘সৌদি আরব যায় ফকিরনিরা, আমার কি টেকা-পয়সার অভাব’’?
৩০ লাখ বাংলাদেশি অধ্যুষিত সৌদি আরবের মরু প্রান্তরে এ নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও বাংলাদেশ সরকারের এ ব্যাপারে কোন মাথাব্যথা ছিল না। ‘মাইক’ নাটকের অপকর্মের সাথে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় এবারের ঈদেও একটি প্রাইভেট চ্যানেলে প্রচারিত হয় আরেক ধারাবাহিক নাটক ‘সেকান্দার বক্সের হাওয়াই গাড়ি’, যেখানে রচয়িতা ও পরিচালক সাগর জাহান অভিনেতা ফারুক আহমেদকে দিয়ে বলিয়েছেন, ‘‘সৌদি আরব প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাজ হচ্ছে খেজুর খাওয়া আর কম্বল নিয়ে ঘুরে বেড়ানো’’। একই ধারাবাহিকে দুবাই প্রবাসী বাংলাদেশিদেরকে উপস্থাপিত করা হয়েছে পরনারীর প্রতি লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপকারী চরিত্রহীন হিসেবে।
শুধু মাইক বা সেকান্দার বক্সই নয়, সময়ে সময়ে আরো বহু প্রোডাকশনেই বেহুদা খাটো করা হয়েছে এবং হচ্ছে বিদেশ বিভুঁইয়ের বিশাল প্রবাসী জনগোষ্ঠীকে। সরকারের তরফ থেকে ন্যূনতম কোন নিয়ন্ত্রণ বা নীতিমালা না থাকায় নেক্কারজনক এই ইস্যুটি এখন রীতিমতো মহামারী আকার ধারণ করতে চলেছে। প্রশ্ন তাই একটাই, কার কানে কে দেবে পানি ?